বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাস পুরনো হলেও যদি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্র বিবেচ্য হয়,তাহলে মূলতঃ ১৯৯৮ সালে আকরাম-দূর্জয়-নান্নু-শান্তদের হাত ধরে আইসিসি ট্রফি জয়ের সময় থেকেই ধরতে হবে।ঐ বিজয়ের পরেই প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ ক্রিকেটে অংশগ্রহণের সুযোগ ও ওডিআই ষ্ট্যাটাস পায় বাংলাদেশ। তিন বছরের মাথায় টেস্ট ষ্ট্যাটাসও অর্জন করে নেওয়া বাংলাদেশ ক্রিকেটের তিন ফরম্যাটের মধ্যে ওয়ানডেতে বিশ্বমানের দল হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করে নেয় আকরাম-নান্নুদের পরবর্তী প্রজন্ম আশরাফুল-মাশরাফি-সাকিব-মুশফিক- তামিম-রিয়াদদের হাত ধরে।
দলটি টি টোয়েন্টিতে এভারেজ মানের উপরে উঠে আসতে পারেনি আজও।আর টেস্টে সবসময়ই ব্যর্থতার বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছিলো।মাঝে মাঝে কিছু দূর্দান্ত জয় এসেছে বটে,কিন্তু ধারাবাহিকতার অভাব সেই জয়গুলোকে মিরাকল হিসেবেই মনে হয়। ক্রিকেটের নাক উঁচু শ্রেণিটা সুযোগ পেলেই আইসিসিকে একহাত নিয়েছে বাংলাদেশকে টেস্ট ষ্ট্যাটাস দেওয়ার জন্য।বিদ্রুপ আর ঠাট্টা করতেও ছাড়েনি বাংলাদেশ দলকে।অবশ্য সবই টেস্ট পারফরম্যান্স কেন্দ্রীক ছিলো।বাকি দুই ফরম্যাট নিয়ে কিছু বলার সুযোগ পায়নি তাঁরা। তবে একটা বিষয়ে পুরো ক্রিকেট বিশ্ব একবাক্যে সহমত পোষণ করেছে,করছে আর করবে আগামী দিনগুলোতে।ইতিমধ্যে ইতিহাসে অমরত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়া বিষয়টি হলো,সাকিব আল হাসান। তিন ফরম্যাটেই নিজেকে প্রমান করা এই বাঁহাতি নিজের পারফরম্যান্স দিয়ে ক্রিকেটে পৃথিবীর সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারের স্বীকৃতি অর্জনের খুব কাছাকাছি জায়গায় আছেন।
সাকিব আল হাসানের নিকট বহু রেকর্ড জমা হয়েছে দিন গড়ানোর সাথে। আরেকটি বিশ্বরেকর্ডও সাকিবের দখলে এসেছে ঐতিহাসিক রাওয়ালপিন্ডি টেস্টে।দৃশ্যতঃ একটি হলেও আমি দেখছি সাকিব আজ দুটো বিশ্বরেকর্ড গড়েছেন।দৃশ্যমান বিশ্বরেকর্ডটি হলো, বাঁহাতি স্পিনার হিসেবে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি উইকেট শিকারী এখন সাকিব।আর দ্বিতীয়টি হলো, সাকিব এই বিশ্বরেকর্ড গড়েছেন একজন হত্যা মামলার আসামী হয়ে!(রাওয়ালপিন্ডি টেষ্টের দ্বিতীয় দিন তাঁর বিরুদ্ধে রাজধানী ঢাকার আদাবর থানায় দায়েরকৃত একটি হত্যা মামলার ২৮ নম্বর আসামী হিসেবে তাঁর নামোল্লেখ করা হয়) আমাদের সংকীর্ণ মানসিকতার এ এক জ্বলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত। যদি সাংবাদিকের নৈতিক দায়িত্ব সত্যকে প্রকাশ করার জায়গা থেকে লিখতে হয়,তাহলে এই সত্যি না লিখে উপায় নেই কোন।খুন সাকিব আল হাসান করেননি বা ওসবের সাথে তাঁর বিন্দুমাত্র সংশ্লিষ্টতা নেই,একথা বাংলাদেশের একটা শিশুও জানে ও বোঝে।তবুও তিনি খুনের মামলার ২৮ নম্বর আসামী হিসেবে অভিযুক্ত আজ।কারন, সাকিব আল হাসান আওয়ামীলীগের টিকিটে গত জাতীয় নির্বাচনে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন। এটাই সাকিবের একমাত্র অপরাধ। জাতি হিসেবে আমরা সত্যিই এক বিষ্ময়।আমরা ঠুনকো অজুহাতে অবলীলায় ভুলে যাই কীর্তিমানের কীর্তিকে।ইতিহাস যাঁকে অমরত্ব দিয়েছে,আমরা তাঁকে সংকীর্ণ মানসিকতার জন্য মুছে ফেলার ব্যর্থ চেষ্টা করি।যে জাতি তাঁদের স্থপতি হিসেবে ইতিহাস স্বীকৃত,তাঁর ভাষ্কর্যের মাথায় মূত্র বিসর্জন করতে পারে,গলায় জুতোর মালা পড়িয়ে চরম অপমানিত করতে পারে, তাঁদের কাছে সাকিব কোন ছাড়!তাই আলোচনা খেলায় নিয়ে যাই।চলুন রাওয়ালপিন্ডিতে। রাওয়ালপিন্ডিতে আজ ২৫ আগষ্ট পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের পাওয়া ঐতিহাসিক জয়ের নেপথ্য নায়ক মুশফিকুর রহিম হলেও প্বার্শ নায়ক হিসেবে মিরাজ ও সাকিবের নাম আসবেই।কেননা গতকাল চতুর্থ দিন শেষে এই টেস্টে ড্র ই ছিলো ক্রিকেট বোদ্ধাগণের অনুমিত ফল।আর বাংলাদেশের জয়ের সম্ভাবনা নির্ভর করছিলো বোলারদের অনেক ভালো পারফরম্যান্সের উপর। বলাই বাহুল্য,পঞ্চম ও শেষ দিনে বাংলাদেশের বোলাররা সেটাই করে দেখালেন। বিশেষ করে প্রথম সেশনে ৮৫ রানে পাকিস্তানের পাঁচ উইকেট তুলে নিয়ে অবিশ্বাস্য জয়ের স্বপ্নটা দলের সকলের ভেতর দৃঢ়ভাবে ক্রিয়াশীল হয়।আর এখানেই সাকিব এসে যান অনিবার্য ভাবে।
পঞ্চম দিন পাকিস্তানের প্রথম দুই উইকেট তুলে নেন দুই পেসার হাসান ও রানা। এরপর উইকেটে আসেন সৌদ শাকিল।যিনি প্রথম ইনিংসে অনবদ্য ১৩৭ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। সাকিব আল হাসান সৌদ শাকিলকে ক্যারিয়ারের প্রথম শূন্য রানে আউট হওয়ার তিক্ত স্বাদ দেওয়ার মাধ্যমে পৌঁছে যান ড্যানিয়েল ভেট্টোরির সমানে। পাকিস্তানের পতন হওয়া উইকেট পরের উইকেটটাও পকেটে পুড়েছেন সাকিব।তেড়েফুঁড়ে বড় শট খেলতে গিয়েই উইকেটটা বিসর্জন দিলেন আব্দুল্লাহ শফিক।অথচ রিজওয়ানের সাথে বড় জুটি গড়ার ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন ঐ শট খেলার আগে পর্যন্ত। আর আব্দুল্লাহ শফিকের আউটের মধ্য দিয়ে রেকর্ডের পাতায় নিজের নামটা তুলেছেন সাকিব। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ইতিহাসে বাঁহাতি স্পিনারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উইকেট এখন তার।পরে আরও একটা উইকেট নেওয়া সাকিবের এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে উইকেট সংখ্যা ৭০৭। সাকিব পেছনে ফেলেছেন নিউজিল্যান্ডের কিংবদন্তি স্পিনার ড্যানিয়েল ভেট্টোরিকে।
৩০৫ ওয়ানডে, ৩৬২ টেস্ট আর ৩৮ টি-টোয়েন্টি উইকেট মিলিয়ে বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার ছিল ভেট্টোরির। রাওয়ালপিন্ডিতে আব্দুল্লাহ শফিকের উইকেট নিয়ে কিউই স্পিনারকে পেছনে ফেললেন বাংলাদেশের অলরাউন্ডার। রেকর্ড গড়া হয় না-কি ভাঙার জন্য।এখনো খেলা চালিয়ে সাকিব আল হাসান সুযোগ পেলে তাঁর বর্তমান সংখ্যা ৭০৭ কে বাড়িয়ে রেকর্ডকে আরও সমৃদ্ধ করবেন নিঃসন্দেহে।কিন্তু একদিন না একদিন তাঁর এই রেকর্ডও হয়তো ভেঙে দিবেন কোন বাঁহাতি।কিন্তু একটি রেকর্ড অভেদ্য হয়ে থাকবে ইতিহাসে।তা হলো,হত্যা মামলার আসামী হয়ে বিশ্বরেকর্ড গড়ার বিশ্বরেকর্ড!