প্রশাসনের কাঠিন্যে যখন মানুষের আশা রুদ্ধ হয়ে আসে, তখনই কেউ কেউ আগমন করেন আশার আলো হয়ে। তেমনই এক নাম—মমতা আফরিন। ২০২৩ সালের ১১ জানুয়ারি রামগড় উপজেলায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন তিনি। সেই থেকে সময় পেয়েছিল এক মানবিক গতি, রামগড়বাসী পেয়েছিল একজন আপনজন। দায়িত্ব নয়, কর্তব্যকে হৃদয়ে ধারণ করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সাধারণ মানুষের জীবনের অংশ। রামগড়ের রাস্তায়, বিদ্যালয়ের আঙিনায়, বন্যার কাদায় কিংবা উৎসবের আলোকসজ্জায়—সর্বত্র ছিল তাঁর সরব উপস্থিতি।
তিনি ছিলেন প্রশাসকের চেয়ারে বসা এক স্নেহময় অভিভাবক, যিনি শুধুই আদেশ দেননি, বরং কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাশে থেকেছেন। ২০২৪ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ভয়াবহ বন্যায় যখন রামগড় বিপর্যস্ত, তখন মমতা আফরিন ছুটে গেছেন দুর্গম অঞ্চলে—জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। কাদা মাড়িয়ে, পা ডুবিয়ে পৌঁছে দিয়েছেন ত্রাণ, সাহস আর সহানুভূতির ছোঁয়া। তাঁর হাত ধরে এসেছে উন্নয়ন—আশ্রয়ণ প্রকল্পে গৃহহীনদের মাথা গোঁজার ঠাঁই, দুর্গম এলাকায় সুপেয় পানির পাম্প, বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার নির্মাণ, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা। শিশুদের জন্য নির্মিত হয়েছে ‘শিশু কানন’—এক টুকরো স্বপ্নের বাগান। নবীন শিক্ষার্থীদের হাতে উপহার তুলে দিয়ে তিনি যেভাবে তাদের বরণ করেছেন, তা প্রশাসনের চেনা গণ্ডি ছাড়িয়ে এক স্নেহপরায়ণ অভিভাবকের ছবি এঁকেছে। তরুণ সমাজকে উজ্জীবিত রাখতে খেলাধুলায়ও ছিল তাঁর অনন্য অবদান। স্কুল-কলেজ পর্যায়ের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় তিনি নিয়মিত উপস্থিত থাকতেন, বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দিতেন।
স্থানীয় ক্রীড়া সংগঠনগুলোকে সহযোগিতা করেছেন খেলোয়াড়দের সরঞ্জাম, মাঠ উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। যা তরুণদের ভেতর নতুন প্রাণ সঞ্চার করে। জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের মতো গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করায় তিনি পেয়েছেন ‘জেলার শ্রেষ্ঠ ইউএনও’ খেতাব। তবে, তাঁর সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি—মানুষের ভালোবাসা। রামগড়ের প্রতিটি হৃদয়, প্রতিটি পরিবার, প্রতিটি প্রার্থনায় উচ্চারিত হয় তাঁর নাম—কৃতজ্ঞতায়। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, “মমতা আফরিন শুধু একজন প্রশাসক নন—তিনি ছিলেন আমাদের আশার বাতিঘর। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের পাশে দাঁড়িয়েছেন। ধর্মীয় ও নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে তিনিই প্রথম এসে পৌঁছাতেন। এমন মানবিক ইউএনও রামগড়বাসীর হৃদয়ে চিরকাল স্মরণীয় থাকবেন।” তাঁর পদোন্নতি ও বদলির খবরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বইছে প্রশংসার ঢেউ।
ফেসবুকজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে একের পর এক ভালোবাসার বার্তা—“তিনি শুধু একজন ইউএনও নন, ছিলেন আমাদের পরিবারের একজন সদস্য।” রামগড়ের মানুষ জানে, আলোকবর্তিকা যেমন যেখানে থাকে, আলো ছড়ায় ঠিক সেখানেই—তেমনি মমতা আফরিনও বান্দরবানে গিয়ে সেখানকার মানুষকেও আপন করে নেবেন। এডিসি হয়ে শিগগিরই বান্দরবান যাবেন তিনি। তাঁর জন্য রামগড়বাসীর প্রার্থনা ও ভালোবাসা রয়ে যাবে চিরকাল।”দায়িত্ব ছিল নিয়ম, আর ভালোবাসা ছিল তাঁর অভ্যাস-তাই তো তিনি শুধুই বদলি হলেন, বিদায় নন।”