গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিবন্ধিত। রেজি নং – ১৬৯

অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ চিরঞ্জীব, চিরভাস্বর

২০০৩ সালের ২১ ডিসেম্বরে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ মৃত্যুবরণ করেন। ১৯২২ সালের তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বিহার রাজ্যের রাজধানী পাঠনায় পিতা আবদুল হাদী চৌধুরীর কর্মক্ষেত্রে জন্মগ্রহণ করেন দেশ বরেণ্য বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। মাতা তামান্না বেগম ছিলেন একজন পর্দানসীন ধর্মপ্রাণ গৃহিনী। পাঁচ ভাই ও পাঁচ বোনের সংসারে তাদের পৈতৃক নিবাস ছিল চট্টগ্রামের রাউজানের সুলতানপুর গ্রামের দারোগা বাড়ি।

১৯৪২ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন কলকাতা ইসলামীয়া কলেজে তক শ্রেণিতে ভর্তি হন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই কলেজের বেকার হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করেছেন। এটি ছিল ভারতের একটি ঐতিহ্যবাহী ও প্রাচীন বিদ্যাপীঠ। পারিবারিক কারণে পাঠ সমাপ্ত না করে দেশে ফিরে এসে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে স্নাতক সমাপ্ত করে পরবর্তীতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাসে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৪৪ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন কালে তিনি বিট্রিশ বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হন। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা হলে তিনি এদেশের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ’৬২-এর কুখ্যাত হামিদুর রহমান শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৪-এর সাম্প্রদায়িক প্রতিরোধ আন্দোলন, ’৬৬-এর ঐতিহাসিক ৬ দফা আন্দোলন ’৬৯-এর গণ আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। ’৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর মনোনীত প্রার্থী হিসেবে রাউজান-হাটহাজারী সংসদীয় আসনে নির্বাচনে অংশ নিয়ে তৎকালীন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকার ফজলুল কাদের চৌধুরীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করেন। এদেশের রাজনীতিক অঙ্গনে তিনি ছিলেন ক্ষণজন্মা পুরুষ। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক স্বাধীনতা পদক প্রাপ্ত এই গুণীজন ব্যক্তি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদীর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ সালে রচিত বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধান প্রণয়ন কমিটির ৩২ জন সদস্যের মধ্যে অন্যতম সদস্য ছিলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ।

’৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে তিনি চট্টগ্রামে ছাত্র ও যুব সমাজকে সংগঠিত করেন এবং সংগ্রাম পরিচালনার জন্য গঠিত ৫ জন সদস্যের মধ্যে অন্যতম সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে কালুরঘাটে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায় তিনি সরাসরি জড়িত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মুজিব নগর সরকারের তথ্য দপ্তরের দায়িত্ব প্রাপ্ত হিসেবে স্বাধীন বংলা বেতারের উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। পাশাপাশি মুজিব নগর সরকারের মূখপাত্র হিসেবে প্রকাশিত ‘জয় বাংলা’ পত্রিকার সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু তাকে বাকশালের উত্তর জেলার গর্ভনর নিযুক্ত করেন। চট্টগ্রামের প্রতি তার অকৃত্রিমক ভালোবাসা ছিল। তিনি ছিলেন মাটি ও মানুষের নেতা। উন্নয়নের ভূমিকা রাখতে শত নাগরিক কমিটি গঠন করে চট্টগ্রামের দলমত নির্বিশেষে সকলকে একিই প্লাটফর্মে আনেন যা অন্য কোন রাজনীতিক নেতার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তিনি ছিলেন অসম্প্রদায়িক ও মুক্ত চিন্তা চর্চার পথিকৃৎ।

এই মহান ব্যক্তিত্বের স্মরণে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব প্রতি বছর অধ্যাপক খালেদ স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করে থাকে। চট্টগ্রাম একাডেমি প্রতি বছর ফেব্রুয়ারিতে অধ্যাপক খালেদ শিশু সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করে থাকে। ইতিমধ্যে বাংলা একাডেমি তাঁর জীবনী গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। তিনি সকল লোভ লালসার উর্ধ্বে ছিলেন। বঙ্গবন্ধু একনিষ্ট ও ঘনিষ্ট সহকর্মী হিসেবে তাঁর অনেক সুখ্যাতি ছিল। জাতীয় পরিষদ সদস্য থাকাকালীন সময়ে সর্বক্ষেত্রে তাঁর অবদান ছিল প্রসংশনীয়। আজকের দিনে অনেক মন্ত্রী, এমপি ও দলের প্রভাবশালী নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি বা সমাজের অপরাধ ঘটানোর প্রবনতা দেখা যায়। অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ এ সবকিছুর উর্দ্ধে ছিলেন। এক কথায় সে সময় সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির ছিটেফোঁটাও ছিল না। তিনি আমাকে খুবই ¯েœহ করতেন। অধ্যাপক খালেদকে নিয়ে অনেকে নানা কথা বলেন। কিন্তু, বাস্তবতা হলো ’৭৫-এর ১৫ আগষ্ট প্রেক্ষাপট নিয়ে অনেক বেশি দুশ্চিন্তা করতেন তিনি। জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর খুনী মোস্তাক, জিয়া যখন আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের উপর নির্যাতনের ষ্ট্রীম রোলার চালানো শুরু করে সেসময় বঙ্গবন্ধুর নাম পর্যন্ত উচ্চারণ করতে দেয়নি খুনী মোস্তাক ও জিয়া। সেই সময় অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ বঙ্গবন্ধুর শাহাদাত বার্ষিকী পালন উপলক্ষে একাধিকবার কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদে খতমে কোরান, দোয়া মাহফিল ও ফাতেয়া পাঠসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন।

দল ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর অগাধ শ্রদ্ধাবোধ ও আনুগত্য ছিল। যার ফলে তিনি খন্দকার মোস্তাকের লোভনীয় প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। সে সময় ইচ্ছে করলে আরাম আয়েশি জীবন যাপন করতে পারতেন। নীতি এবং আদর্শের প্রতি অবিচল থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর জয়গান গেয়েছেন। পরিবারের জন্য তেমন কোন সম্পত্তিও রেখে যাননি। মৃত্যুর এক মাস আগে তাঁর বড় ছেলে মো. জমির দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ছোট ছেলে মো. জহির সাপ্তাহিক স্লোগান পত্রিকার সম্পাদক। আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন তার শ্বশুর ও বর্তমান সম্পাদক এম. এ. মালেকের ভগ্নিপতি। আমার মরহুম পিতা আবদুল মাবুদ সওদাগরের সাথে তাঁর ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল। ২০০১ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে চেরাগী পাহাড়স্থ সেন্টার পয়েন্ট হাসপাতালে আমার অসুস্থ পিতাকে দেখতে আসেন তিনি এবং সেখানে দীর্ঘ সময় অবস্থান করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সুস্থ অবস্থায় তিনি কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ সহ পবিত্র জুমার নামাজ পড়তেন। আপাদমস্তক একজন ভ্রদলোক ছিলেন তিনি। বয়সে ছোট হলেও কাউকে আপনি ছাড়া তুমি বলে সম্বোধন করতেন না। কোন উচ্চ বিলাসী মনোভাব তাঁর মাঝে ছিল না। কোনদিন দামি গাড়িতে চড়তে দেখিনি। সবসময় রিকশায় ছড়তেন অথবা পায়ে হেঁটে আজাদী অফিসে আসতেন। দেওয়ান বাজারস্থ আমেনা মঞ্জিলে একটি ভাড়া বাসায় জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন। দৈনিক আজাদীর মতো ঐতিহ্যবাহী ও বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রের সম্পাদক হয়েও তাঁর মাঝে কোনো অহংকার ছিল না।

একজন সম্পাদকের উপর নির্ভর করে পত্রিকার জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা। তিনি সুদীর্ঘ ৪৩ বছর সততা ও নিষ্টার সাথে আজাদীর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। চট্টগ্রামের রাজনীতিকরা তাদের যে কোন সংবাদ অন্য পত্রিকায় প্রকাশের পূর্বে আজাদীতে প্রকাশিত হয়েছে কিনা সেটা আগে দেখতেন। অধ্যাপক খালেদ ছিলেন একজন ক্ষনজন্মা পুরুষ। তাঁর এই শূণ্যতা কখনো পূরণ হওয়ার নয়। তাঁর মৃত্যুতে আমরা হারিয়েছি একজন রাজনীতিক অভিভাবক। দেশবাসী হারিয়েছে বরণ্যে এক বুদ্ধিজীবীকে। ২০২২ সালে তাঁর জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের জন্য চট্টগ্রামবাসীকে ব্যাপক কর্মসূচি পালন করতে একটি নাগরিক কমিটি গঠন করে তাঁর বর্ণাঢ্য রাজনীতিক জীবনের নীতি, আদর্শ, ত্যাগ ও সফলতা তুলে ধরে বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপট ভিন্ন।

এখন টাকা ছাড়া কোন রাজনীতি বা ভোট হয় না। ভোটের আগে পরে যে যত বেশি টাকা খরচ করতে পারে সে তত সফলতা অর্জন করে। জেনারেল জিয়া একটি কথা বার বার বলতেন- “আই মেইক ডিফিকাল্ট পলিটিক্স ফর দ্যা পলিটিসিয়ান।” অর্থাৎ আমি রাজনীতিকদের জন্য রাজনীতিকে জটিল করে দেবো। টাকার কাছে নীতি-আদর্শ পরাজিত হয়েছে। অধ্যাপক খালেদের আদর্শ যেন এদেশের রাজনীতিক নেতাকর্মীদের চলার পথের পাথেয় হয়। ১৮তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি। দোয়া করি আল্লাহ যেন তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করেন।

 

এই বিভাগের সব খবর

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে মিয়ানমারের বিদায়ী রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাত

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সাথে মিয়ানমারের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত অং কিও মো আজ সাক্ষাত করেছেন। আজ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এই সাক্ষাত অনুষ্ঠিত হয়। রোহিঙ্গাদের পূর্ণ নাগরিক অধিকারসহ...

বিএনপি নেতারা মানসিক ট্রমায় ভুগছেন : ওবায়দুল কাদের

বিএনপি নেতারা মানসিক ট্রমায় ভুগছে, সে কারণে আবোল তাবল বলছে বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল...

অক্টোবরে মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন

চট্টগ্রাম মহানগরে আওয়ামী লীগের ইউনিট, ওয়ার্ড ও থানা কমিটির সম্মেলন আগামী ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে শেষ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। যা শুরু হবে চলতি সপ্তাহ...

সর্বশেষ

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে মিয়ানমারের বিদায়ী রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাত

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সাথে মিয়ানমারের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত অং...

বিএনপি নেতারা মানসিক ট্রমায় ভুগছেন : ওবায়দুল কাদের

বিএনপি নেতারা মানসিক ট্রমায় ভুগছে, সে কারণে আবোল তাবল...

অক্টোবরে মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন

চট্টগ্রাম মহানগরে আওয়ামী লীগের ইউনিট, ওয়ার্ড ও থানা কমিটির...

চুয়েটের সাথে তিনটি সংস্থার সমঝোতা স্মারক

চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)- এর সাথে সিগনাল...

প্রবাসীর স্বর্ণ ছিনতাই, পুলিশের এসআইকে হাতেনাতে ধরল জনতা

চট্টগ্রামে পাঁচলাইশ থানাধীন টাইগার পাস এলাকায় স্বর্ণ ছিনিয়ে নিয়ে...