গত ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪ কোস্ট ফাউন্ডেশন ও এসডিআই এর যৌথ আয়োজনে সন্দ্বীপ উপজেলা পরিষদ সম্মেলন কক্ষে “সমন্বিত স্থানীয় জলবায়ু বাস্ত্তচ্যুতি ব্যবস্থাপনা ও পুনর্বাসন প্রক্রিয়া শক্তিশালীকরণ” শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।
সেমিনারে উপজেলা পর্যায়ের বিভিন্ন দপ্তরের সরকারি কর্মকর্তা, নাগরিক সমাজ, এনজিও প্রতিনিধি, সাংবাদিক, ও বাস্ত্তচ্যুত জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন ও তাদের তাৎপর্যপূর্ণ মতামত ব্যক্ত করেন- বিভিন্ন গবেষণা ও স্থানীয়দের তথ্যমতে, ৭৬২.৪২ বর্গ কি:মি: থেকে সন্দীপের আয়তন বর্তমানে ২৭০ বর্গ কি:মি: [উড়িরচর সহ] অর্থ্যাৎ বর্তমানে আয়তন তিন ভাগের একভাগ মাত্র। এক সময় ৬০টি মৌজা নিয়ে গঠিত এই উপজেলার বর্তমানে মৌজার সংখ্যা ২৫ টির মতো । ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ের পর থেকেই এখানে ভাঙ্গনের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। বাস্ত্তচ্যুত পরিবারের অধিকাংশই চট্টগ্রাম শহর ও তার আশেপাশের অঞ্চলগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে, চট্টগ্রাম শহর ছাড়াও হাটাজারী ও রাঙ্গুনিয়াতেও সন্দ্বীপ পাড়া রয়েছে। উপস্থিত উপজেলা কৃষি, প্রাণিসম্পদ ও দুর্যোগ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাবৃন্দ ও স্থানীয় ভুক্তভোগীদের বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট- টেকসই বেড়িবাঁধ না থাকার কারনে জোয়ারের পানি প্রবেশ করে এবং দিন দিন লবনাক্ততার মাত্রা তীব্র হচ্ছে তাই প্রত্যাশা অনুযায়ী ফসল উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে, জীবিকা হারিয়ে অনেকেই পরিবার সহ অন্যত্র পাড়ি জমাচ্ছে। ভুক্তভুগী জনগোষ্ঠী ও সাংবাদিকদের বক্তব্যে জানা গেল, ২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে সন্দ্বীপ উপজেলার সারিকাইদ থেকে সন্তোষপুর পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সংস্কার করা হয়েছিলো। এই বেড়িবাঁধের দুপাশে প্রায় ১০ হাজার বাস্ত্তচ্যুত পরিবার বাস করতো, সংস্কারের সময় তারা প্রত্যেকেই আবার বাস্ত্তচ্যুত হয়েছিলো, ২ হাজার এর মতো পরিবার আশেপাশে কোথাও কোন রকম টিকে থাকলেও ৮ হাজার পরিবার কোথায় গিয়েছে সেই তথ্য কারো কাছেই নেই বা নেয়ার প্রয়োজনও বোধ করেনি কেউ । সরকারি বরাদ্দে বেশ কিছু আশ্রায়ন প্রকল্প করা হয়েছে এখানে, আমরা সে সকল আশ্রায়ন প্রকল্প থেকে বেশ কিছু বাসিন্দাদের আমন্ত্রন জানিয়েছিলাম তাদের অনুভুতি/ অভিজ্ঞতা অন্যদের সাথে বিনিময় করার জন্য।
প্রায় প্রত্যেকের অভিজ্ঞতা এক ও অভিন্ন, প্রকৃত চিত্র বুঝতে একটি উদাহরনই হয়তো যথেষ্ট- দীর্ঘাপাড় ইউনিয়ন আশ্রায়ন প্রকল্প [বাস্ত্তচ্যুত পূনর্বাসনের একটি উদাহরনমাত্র] আশ্রায়ন প্রকল্পটি নিকটস্থ লোকালয়/ জনবসতি থেকে প্রায় ৫কি: মি; দূড়ে অবস্থিত। ৫ কিমি: এর মধ্যে কোন ঔষুধের ফার্মেসি নেই, নেই কোন চিকিৎসা সেবা। আশেপাশে ৫ কি: মি: এর মধ্যে কোন প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই ফলে সেখানকার কোন শিশু বিদ্যালয়ে যায়না। দেয়াল/বাথরুম এর অবস্থা অত্যান্ত নাজুক বিভিন্ন স্থানে ফাটল দেখা দিয়েছে। আশ্রায় নেয়া পরিবারগুলোর বেশিরভাগই ঐ ইউনিয়নের নাগরিক না হওয়ায় সকল প্রকার সামাজিক সুরক্ষা সেবা থেকে তারা বঞ্চিত। স্থানীয়ভাবে কর্মসংস্থান না থাকা ও লোকালয় খেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় ২৪০ টি ঘরের মধ্যে অর্ধেক এখনো ফাঁকা। ধর্ষনের মতো ঘটনা ঘটায় পরিবারগুলোর মধ্যে চাপা আতংক বিরাজ করছে, তারা অন্যত্র সরে যাওয়ার চেষ্টা করছে। প্রকল্প নির্মানের সময় আশেপাশে কিছু জলাশয় সৃষ্টি হয়েছিলো সেগুলো স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলে ফলে এগুলো ব্যবহার করে অর্থনৈতিক আয় উন্নতির সুযোগ তাদের নেই। স্থানীয় প্রভাবশালীরা পুকুরগুলোতে জোরপূর্বক গরু-মহিষকে গোসল করায়, ফলে পুকুরের পানি ব্যবহারের অনুপযোগী। আশ্রায়ন প্রকল্পটি বেড়িবাঁধ এর বাহিরে ও দুর্যোগ ঝুকিপূর্ন স্থানে অবস্থিত, ফলে দুর্যোগকালীন সময় পরিবারগুলোকে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে হয়। আশ্রায়ন প্রকল্পে আশ্রয় নেয়ার ফলে তারা সামাজিকভাবে যথেষ্ট হেয় ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছে তাদের সাথে কেউ আত্মীয়তার সমন্ধ করতে চায়না, বিয়ে/আচার অনুষ্ঠানের বিষয়গুলো অনুনয় বিনুনয় করে আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে সম্পন্ন করতে হয়। সেমিনারে উপস্থিত প্রায় প্রত্যেকের সুপারিশ- উপকূলীয় ঝুকিঁপূর্ণ অঞ্চলগুলোকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে বরাদ্দ বাড়াতে হবে, টেকসই উপকূলীয় সুরক্ষা বেরিবাঁধ নির্মান করতে হবে, জনঅংশগ্রহণ ও স্থানীয়দের মতামতের ভিত্তিতে অঞ্চলভিত্তিক বাস্ত্তচ্যুত পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়; কাজের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে না পারলে স্বল্প/দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনাও হবে, বরাদ্দও খরচ হবে; দীর্ঘাপাড় ইউনিয়ন আশ্রায়ন প্রকল্পের মতো কাজের কাজ আসলে কিছুই হবেনা।