চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) মেয়র হিসেবে শপথ নিয়ে বিএনপি নেতা ডা. শাহাদাত হোসেন বলেছেন, আমার লক্ষ্য চট্টগ্রামকে গ্রিন, ক্লিন ও হেলদি সিটি হিসেবে গড়ে তোলা। ২০২১ সালে মেয়র নির্বাচনের আগে ইশতেহারের মাধ্যমে আমি নগরবাসীর কাছে এ অঙ্গিকার করেছিলাম। আমি আমার ইশতেহার বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ আজ রবিবার সকালে সচিবালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের সম্মেলন কক্ষে শপথ পাঠ করানোর পর বের হয়ে উপস্থিত সাংবাদিক ও ঊচ্ছ্বসিত জনতার সামনে ডা. শাহাদাত হোসেন এ কথা বলেন।
‘চট্টগ্রাম বাঁচলেই বাংলাদেশ বাঁচবে’ উল্লেখ করে নতুন মেয়র বলেন, ‘যদি চট্টগ্রাম শহরের ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপ করা যায় বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। ভৌগলিকভাবে চট্টগ্রাম এমন একটি জায়গায় রয়েছে যেখানে পাহাড়, সমুদ্র, পর্যটন, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল থেকে শুরু করে প্রতিটিতে এই চট্টগ্রাম নগরের ওপর দিয়ে যেতে হয়। কাজেই চট্টগ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে – এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।’
তিনি বলেন, ‘আমরা দেখেছি বাংলাদেশের জিডিপিতে গার্মেন্টস খাত, মানবসম্পদ, কৃষিখাত শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হাত ধরে এগিয়ে গিয়েছিল। আর এ তিনটি খাত এখনো পর্যন্ত জিডিপিতে অবদান রাখতে পারলেও চতুর্থ আরেকটি খাত পর্যটন জিডিপিতে অবদান রাখতে পারছে না। অথচ পর্যটন শিল্পকে ব্যবহার করে সার্কভুক্ত দেশগুলো এগিয়ে যাচ্ছে, শুধুমাত্র বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের কথা বলে এ খাতকে পিছিয়ে দেয়া হয়েছে। এই খাতটিকে ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারেনি অতীতের সরকার।’
চসিক মেয়র বলেন, এ দেশে ভ্রমণের ক্ষেত্রে সবার প্রথমেই কক্সবাজারের কথা মনে আসে। এরপর চিন্তা করেন বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির কথা। এসব জায়গায় যেতে হলে চট্টগ্রাম শহরের ওপর দিয়ে যেতে হবে। তাই শহরের অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা এদিকে নজর দেবেন বলে আমি আশাবাদী।’
নগরের প্রধান সমস্যা জলাবদ্ধতার কথা তুলে ধরে ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘জলাবদ্ধতার প্রকল্প যেটি চসিকের মাধ্যমে হওয়ার কথা ছিল, সেটি ২০১৬ সাল থেকে সিডিএ’র মাধ্যমে হচ্ছে। ১১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের এ প্রকল্প ২০২৬ সালে শেষ হবে। তখনই জলাবদ্ধতার একটি রেজাল্ট পাব। আর নগর সরকার গঠন করা গেলে সেবা ও উন্নয়ন আরও পরিকল্পিতভাবে হবে। নগরের অনেক রাস্তাঘাটের অবস্থা বেসামাল অবস্থায় রয়েছে। দায়িত্ব নিয়ে রাস্তাঘাটের সমস্যা দ্রুতই নিরসন করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘চসিকের মেয়র হিসেবে আমার দায়িত্ব আছে। তাই আমি মনে করি, এখানে যারা সেবা প্রদানকারী সংস্থা আছে সিডিএ, ওয়াসা, পানি উন্নয়ন বোর্ড, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশসহ সবাইকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করে চট্টগ্রামকে একটি আধুনিক নগর করার চেষ্টা করবো। সেক্ষেত্রে সবার সহগযোগিতা কামনা করছি। কারণ এটা একটা সিস্টেমের ব্যাপার।’
বিভিন্ন করপোরেশনের কথা তুলে ধরে ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘অন্যান্য করপোরেশনের চেয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নাগরিক বেশি। এখানে প্রায় ৭০ লাখ নাগরিক রয়েছেন। এটা একটা বড় শহর। এ শহরটা আমার একার নয়, এটা আমাদের। এ চিন্তা মাথায় রেখে যদি সবাই কাজ করি তাহলে চট্টগ্রাম শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম গর্বের নগরীতে পরিনত করা সম্ভব।’
বাসস’র সাথে আলাপকালে ডা. শাহাদাত বলেন, ‘আমার লেখাপড়া ও রাজনীতির প্রায় পুরোটা জুড়েই আছে চট্টগ্রাম শহর। স্বাভাবিকভাবে এ নগরীর প্রতি আমার একটা আলাদা দরদ আছে। শিক্ষাজীবনে ছাত্রদলের এবং পরে বিএনপির রাজনীতির সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত থাকার সুবাদে এ নগরীর সমস্যা এবং সম্ভাবনা সম্পর্কে আমি ভালোভাবে অবগত আছি। ফলে সমস্যা নিরসনের পাশাপাশি চট্টগ্রামকে একটি আধুনিক ও বাসযোগ্য নগরীতে উন্নীত করতে আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে।’
তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামকে গ্রিন, ক্লিন ও হেলদি সিটি হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে দায়িত্ব গ্রহণের দিন থেকে আমি পরিকল্পিতভাবে কাজ শুরু করবো। নগরবাসীর কাছে আমার পরিকল্পনা তুলে ধরে তাদের সার্বিক সহযোগিতা চাইবো। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সহায় হলে চট্টগ্রাবাসী ও সরকারের সহযোগিতায় আমি নগরীকে ঘিরে আমার লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারবো বলে বিশ^াস করি।’
ছাত্রজীবন থেকে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও পরে বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় থেকে বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও নগর বিএনপির আহবায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ডা. শাহাদাত। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে, বিশেষ করে গত ১৬ বছরে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার শাসনামলে অসংখ্য হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন বিএনপির নিবেদিতপ্রাণ এ নেতা। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার জেরে এ সময়ে বহুবার তাকে কারাভোগ করতে হয়েছে। ফিজিক্যাল মেডিসিন ডা. শাহাদাত পেশাগত জীবনে চট্টগ্রামবাসী এবং চট্টগ্রামের ক্রীড়াবিদদের চিকিৎসা সেবায় অনন্য ভূমিকা পালন করলেও রাষ্ট্রীয় প্ল্যাটফরমে গণমানুষের কল্যাণে কাজ করার এটাই প্রথম পদপ্রাপ্তি।
চট্টগ্রামবাসী আশা করেন, অতীতে রাষ্ট্রীয় বা স্থানীয় সরকার প্রশাসনের কোনো পদে না থেকেও তিনি রাজনীতি ও পেশাগত জীবনে সাধারণ মানুষের পাশে থেকেছেন। সজ্জন, বিনয়ী ও স্বচ্ছ ব্যক্তি হিসেবে চট্টগ্রামে তার একটি পরিচ্ছন্ন ভাবমুর্তি রয়েছে। এমন একজন রাজনীতিবিদ চট্টগ্রামের নগরপিতা হিসেবে নগরীর সর্বোচ্চ দেখ-ভাল করবেন এটাই দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের প্রত্যাশা।
শাহাদাত হোসেন ১৯৬৬ সালের ২ জুন চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার হরলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শিশুকাল থেকে নগরীর বাকলিয়ার পৈত্রিক বাড়িতে থেকে পড়াশুনা করেছেন। তিনি বাকলিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন মেধাবী ছাত্র। স্কুল ও কলেজ জীবনশেষে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। ছাত্রদলের মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া বিএনপি নেতা ডা. শাহাদাত হোসেন নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সাহসী ভূমিকা রাখেন। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) ছাত্রদলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এমবিবিএস পাস করার পর ডক্টরস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ড্যাবের রাজনীতিতে সক্রিয় হন। চট্টগ্রাম নগরীর বাকলিয়া থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও পরে সভাপতি ছিলেন তিনি। বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয় ডা. শাহাদাতকে। তিনি নগর বিএনপির একাধারে সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করার পর সর্বশেষ আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের পাশাপাশি পেশাগত জীবনে একজন সফল চিকিৎসক শাহাদাত হোসেন। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করার পর তিনি ফিজিক্যাল মেডিসিন বিষয়ে এমডি করেন। চিকিৎসা পেশায় বেশ সুনাম রয়েছে তাঁর।
আগামী ৫ নভেম্বর ঢাকা থেকে সকালে রেলপথে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওয়ানা দেবেন চসিকের নতুন মেয়র। দুপুরে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে দলীয় নেতারা ফুল দিয়ে স্বাগত জানাবেন। পরে সেখান থেকে হযরত আমানত শাহ এবং হযরত বদর শাহ (রহ.) এর দরগাহ জেয়ারত করবেন তিনি।
এরপর তিনি সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে লালদিঘির পাড়স্থ নতুন ভবনে বৈঠক করবেন। পরে সেখানেই সাংবাদিকদের সাথে কথা বলবেন। বাদে আসর লালখান বাজারস্থ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন কার্যালয়ে যাবেন। সেখানে খতমে কোরআন ও খতমে গাউছিয়া শেষে মোনাজাতে অংশ নেবেন। । পরদিন ৬ নভেম্বর থেকে নিয়মিত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে অফিস করবেন।
প্রসঙ্গত, ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দিনভর গোলাগুলি, সংঘর্ষ, হামলার ঘটনার মধ্যে ভোটগ্রহণ শেষে আওয়ামী লীগের প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরীকে বিজয়ী ঘোষণা করেন রিটার্নিং অফিসার। এ সময় নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখান করে ২০২১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে ওই নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগে ৯ জনকে বিবাদী করে মামলা করেন নগর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক ডা. শাহাদাত হোসেন।
গত ১৭ অক্টোবর ডা. শাহাদাত হোসেনকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল বিজয়ী ঘোষণা করেন। এর পর সাবেক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর স্থলাভিষিক্ত করে সংশোধনী গেজেট প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন। সম্প্রতি স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে মেয়রদের অপসারণ করা প্রজ্ঞাপন সংশোধন করায় চসিক মেয়র হিসেবে শপথ নিতে আইনি বাধা পুরোপুরি কেটে যায় ডা. শাহাদাতের।