সালমান শাহ, যিনি কিনা বাংলা সিনেমার ক্ষণজন্মা এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম। ১৯৯৩ সালে সোহানুর রহমান সোহান পরিচালিত ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমার মাধ্যমে বড়পর্দায় অভিষেক হয় তার। মাত্র চার বছরের ক্যারিয়ারে দর্শকদের ২৭টি সিনেমা উপহার দিয়েছেন। প্রায় সবগুলো সিনেমাই ছিল সুপারহিট।
১৯৭০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সিলেটে জন্ম সালমান শাহর। বেঁচে থাকলে আজ (১৯ সেপ্টেম্বর) ৫৪ বছরে পা রাখতেন তিনি। কিন্তু সেটি হয়নি। ধূমকেতুর মতো আবির্ভাব হওয়া এ নায়ক ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। তবে অল্প ক’দিনের ক্যারিয়ারেই জায়গা করে নিয়েছেন দর্শকহৃদয়ে। যে কারণে মৃত্যুর এত বছর পরও তাকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন ইন্ডাস্ট্রির সহকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ সিনেমাপ্রেমী দর্শকরা।
ফ্যাশন-স্টাইলিশ এ নায়ক আর নেই―এ কথা এখনো বিশ্বাস করতে পারেন না তার ভক্ত, শুভাকাঙ্ক্ষী ও নেটিজেনরা। তার মৃত্যু নিয়ে বিভিন্ন সময় নানান প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে অভিনেতার মা নীলা চৌধুরীর দাবি, সালমান শাহ আত্মহত্যা করেনি। তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে, কিছুদিন আগেই লন্ডন থেকে এক সাক্ষাৎকারে এমনটাই জানান সালমান শাহর মা।
সালমান শাহর মৃত্যু নিয়ে ধোঁয়াশার মধ্যে তার মায়ের এমন দাবিতে বারবার আঙুল উঠে অভিনেতার স্ত্রী সামিরার দিকে। কেননা তার মা এ ব্যাপারে আইনের আশ্রয় নিয়েছেন। যেখানে এক নম্বর আসামি করা হয়েছে সালমানের স্ত্রী সামিরাকে। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে সালমান শাহ হত্যায় তার স্ত্রীকে দোষারোপ করা হয়ে আসলেও কখনো এ নিয়ে কখনো কথা বলেননি সামিরা।
অভিনেতার স্ত্রী বারবার নিজেকে আড়ালে রাখতে চেয়েছেন। তবে যা বলার তা আদালতে বলেছেন। কখনো সংবাদমাধ্যমে কথা বলতে দেখা যায়নি তাকে। তবে এবার গণমাধ্যম-এ সালমান শাহ হত্যা নিয়ে সরাসরি খোলামেলা কথা বললেন সামিরা।
অভিনেতার জন্মদিনের আয়োজনের ব্যাপারে তিনি বলেন, ইমন (সালমান শাহর ডাক নাম) আসলে সবসময় নিজের জন্য নয়, অন্যের কথা ভাবতেন। এটা অনেক বড় একটি গুণ ছিল ওর। সে কখনো সেভাবে নিজের জন্মদিন উদযাপন করত না। তবে আমার জন্মদিনে সবসময়ই বিশেষ কিছু করার চেষ্টা করত।
তিনি বলেন, একবার ১১ তলা বিল্ডিং থেকে আমার চোখ বেঁধে নিচে নামায়। পরে চোখ খুলে দেখি উপহারের প্যাকেটে মোড়ানো একটি গাড়ি। আমি ওইদিন অবাক হয়েছিলাম ওর এমন উপহার দেখে। যে লাল গাড়িটি সবাই দেখেছেন, সেটি আসলেই আমাকে জন্মদিনে উপহার দিয়েছিল ইমন। এমন অসংখ্য সারপ্রাইজ দিয়েছে সে।
দাম্পত্যজীবন সম্পর্কে সালমান শাহর স্ত্রী সামিরা বলেন, কেন না। আমরা দু’জন দু’জনে ভীষণ ভালোবাসতাম। অনেক হ্যাপি ছিলাম। কখনো দু’জনের মধ্যে মনোমালিন্য হলে তা ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে দিতো ইমন।
অভিনেতার স্ত্রী বলেন, বিয়ের আগে সালমানের মা (নীলা চৌধুরী) আমাকে অনেক পছন্দ করতেন। কিন্তু বিয়ের পর যখন তিনি জানতে পারলেন এই বিয়েতে আমার পরিবারের মত ছিল না, তখন থেকেই আমাকে অপছন্দ করতে লাগলেন তিনি। তাকে সবসময়ই আমি মা হিসেবে দেখতাম, শাশুড়ি হিসেবে নয়। এরপরও তার সঙ্গে আমার কেন এমন দূরত্ব হয়েছে, সেটি জানা নেই আমার।
১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর রাজধানী ইস্কাটনের সেই বাসায় কী হয়েছিল, যে কারণে সেদিন আত্মহত্যা করতে হলো সালমান শাহর―এ ব্যাপারে নায়কের স্ত্রী সামিরা বলেন, আত্মহত্যা করার মতো সেদিন কিছুই হয়নি। ওর সঙ্গে একটু কথা কাটাকাটি হয়েছিল। একপর্যায়ে অভিমান করে সে রুমে চলে যায় এবং দরজা বন্ধ করে দেয়। ওই সময় অন্য একটি রুমে ছিলাম আমি। আর এই সময়ের মধ্যেই সবকিছু ঘটে যায়। পরে আমি চিৎকার করলে ফ্ল্যাটের লোকজন ছুটে আসে। খবর পাওয়ার পর ইমনের মা-ও ছুটে আসে। তারপর রুম থেকে ইমনের ঝুলন্ত মরদেহ বের করা হয়।
সামিরা বলেন, ওর সঙ্গে এমন কথা কাটাকাটি এর আগেও হয়েছে। আমার ওপর অনেক অভিমান করেছিল সে। আরেকটি বিষয়, সে কিন্তু এর আগেও তিনবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু চতুর্থবার তাকে ফেরানো সম্ভব হয়নি। যদি মেট্রোপলিটন হসপিটালে খোঁজ নেন, তাহলে রেকর্ড ফাইল ঘাঁটলে সেটি জানতে পারবেন।
সালমান শাহর আগে তিনবার আত্মহত্যা করতে চাওয়ার ব্যাপারে তার স্ত্রী সামিরা বলেন, কেন তা সঠিক জানা নেই আমার। ওই তিনবারই ছিল আমাদের বিয়ের আগের ঘটনা। দুইবার মেট্রোপলিটন হসপিটালে এবং একবার বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হসপিটালে নেয়া হয়েছিল। চাইলে হাসপাতালের রেকর্ড ফাইল চেক করতে পারেন। আসলে মানসিকভাবে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি কাজ করতো ইমনের মধ্যে।
তিনি বলেন, যেদিন আত্মহত্যা করে ইমন, ওকে ওর পরিবারের মানুষজন দ্রুত হাসপাতালে নেয়। চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করলে ওর মরদেহ বিমানবন্দরে নেয়া হয়, সেখান থেকে নেয়া হয় সিলেটে। আমাকে শেষ বারের মতোও ওর মুখটা দেখতে দেয়া হয়নি।
এ ব্যাপারে সামিরা আরও বলেন, আত্মহত্যার দিন ইস্কাটনের বাসায় ওর মা আমাকে অনেক আজেবাজে কথা বলে বের করে দেয় বাসা থেকে। সেখানে ইমনের ছোট ভাই ও মামাও ছিল। তারাই ইমনকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমি হাসপাতালে বা সিলেট যেতে চাইলে আমাকে আসতে দেননি তারা।
এদিকে সালমান শাহর মা নীলা চৌধুরী বিভিন্ন সময় সংবাদমাধ্যমে দাবি করেছেন, আলোচিত ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল সামিরার। এ কারণেই নাকি তার ছেলেকে (সালমান শাহ) হত্যা করা হয়েছে। এ ব্যাপারে সামিরা বলেন, এটি একদমই মিথ্যা ও ভিত্তিহীন কথা। তিনি রটিয়েছেন এসব। উনি এমন কথাও রটিয়েছেন, একটি অনুষ্ঠানে আমার গায়ে হাত রাখে আজিজ মোহাম্মদ ভাই। সেই অনুষ্ঠানে ইমনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব হয় তার। এটিও আসলে মিথ্যা।
সালমান শাহর স্ত্রী সামিরা বলেন, আসলে এ ধরনের কোনো ঘটনাই ঘটেনি। আজিজ মোহাম্মদ ভাই ও আমাকে জড়িয়ে যেসব কথা ছড়ানো হয়েছে, তা সবই মিথ্যা। আমি তো আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে চিনতামই না ভালো করে। ইমনের মা চিনতেন। আরও অনেককেই চিনতেন তিনি।
সবশেষ সামিরা বলেন, ইমনের বাবা ছিলেন একজন ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি যখন রমনা থানায় মামলাটি দায়ের করেন, তখন কিন্তু এটি ইউডি মামলা (অপমৃত্যু) হিসেবে ফাইল করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে ইমনের (সালমান শাহ) মৃত্যুকে হত্যা বলা শুরু করেন তার মা। এমনকি সবশেষ মামলাও করেন তিনি।