মানুষই মানবতার ত্রাতা, মানুষই সৃষ্টি, মানুষই মুক্তি। এই রীতিতেই মানবসমাজকে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা। কিন্তু আজকাল পৃথিবীর নানা দেশ ও মানুষের দিকে তাকালে যে দৃশ্যপট উপলব্ধিতে আসে তা কোনোভাবে মনুষ্যজগতের সাথে মিল খুঁজে পাওয়ার মতো নয়। বিশ্বব্যাপী সর্বত্র এখন মানবতার সংকট চলছে। আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগে পৃথিবীর বুকে মনুষ্য সৃষ্টির মুহুর্তে নিজেদের মধ্যে প্রতিনিয়ত নিপীড়ন বঞ্চনা, কলহ, দ্বন্দ্ব বিভাদ লেগে থাকতো, এমনো ছিল নিজেরাই নিজেদের প্রাণ সংহার করে ভক্ষণ করতো। সাম্প্রতিক ছাত্রদের কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে রকম প্রাণ সংহারের ঘটনা ঘটেছে তা দেখে মনেহলো আমরা কী তাহলে পুনরায় সেই অন্ধকার জগতে ফিরে যাচ্ছি? মানুষ হয়ে যখন মানুষকে বেদম পিঠিয়ে গাছ বা ব্রীজে ঝুলিয়ে রেখে পুরো শরীর ছিন্ন বিছিন্ন করে মুখ, মাথা থেতলিয়ে দিয়ে মৃত্যু নিশ্চিতের উল্লাস করে তাদেরকে আমি কোনোভাবে মানুষ বলতে পারিনা। মানুষ নামের দানবগুলো শুধু এতে সীমাবদ্ধ ছিলনা; রীতিমতো চিনতে না পারে মতো পশুর প্রাণির মতো যেভাবে শরীর থেকে ওপরের চামড়া বিচ্ছিন্ন করে ফেলে ঠিক কয়েকজন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে পিঠিয়ে মেরে গলা থেকে মাথা মুখমন্ডলের চামড়া তুলে ফেলে যাতে তার পরিচয় জানতে না পারে, সে রকম পৈশাচিক উল্লাসে মেতে ওঠে একদল দুর্বৃত্ত জনতা। যে বা যারা এই নৃশংসতম হত্যাকান্ডে জড়িত ছিল তাদের যদি সামন্যতমও মনুষ্য জ্ঞান থাকতো তাহলে একজন মানুষ হয়ে অপর আরেক মানুষকে মধ্যযুগীয় বর্বরতা করতে পারতো না। নারায়নগঞ্জের যে নারী সাংবাদিককে শত শত নরপিশাচ নামের দানব ঘিরে ধরে পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে তার মুখে আগুন লাগিয়ে জ্বলশিয়ে দিতে মন কাঁধেনি তাদেরকে কীভাবে মানুষ বলা যায় ?
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে একশ্রেণির দুর্বৃত্ত জুলাইয়ের মধ্যভাগ থেকে আগষ্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ শতাধিক সাধারণ ছাত্র-জনতা থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষকে নির্বিচারে গণহত্যা, হামলা, ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রিয় সম্পদ আগুনে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্ট হয়েছে। আন্দোলন চলাকালে পুলিশ ও র্যাবের ৪২ সদস্য মৃত্যু বরণ করেছেন বলে পুলিশ প্রধান নিশ্চিত করেছেন। রাষ্ট্র সংস্কারের অংশ হিসেবে সবগুলোর বিচার হওয়া প্রয়োজন। দেশে দৃর্বৃত্তাপরায়ন এ সংবাদ বিশ্বমিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব লক্ষ্য করা গেছে। একবিংশ শতাব্দীতে আধুনিক বিজ্ঞান বিশ্ববাসীকে যতখানি এগিয়ে নিয়েগেছে ততটুকু মানুষের মধ্যে মনুষ্যজ্ঞান লুপ্ত হয়েছে। তাই দেশে দেশে মরণাস্ত্রের ঝনঝনানি আর বিধ্বংসী মিশাইল বোমা আর গ্রেনেড হামলায় প্রতিনিয়ত মানুষ পশুপ্রাণীর মতো মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। এশিয়া থেকে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা থেকে দক্ষিণ আমেরিকা কিংবা আফ্রিকা মহাদেশ সর্বত্রই চলছে আধিপত্য বিস্তারের খেলা। আজকে বাংলাদেশে রাজনীতির নামে সর্বত্র দলীয়করণ থেকে সৃষ্টি হয়েছে লুটপাটের রাজত্ব। বিশ্বব্যাপী রাজনীতিকরা সাধারণ জনগণের সেবক হয়ে দুঃখলাগবের কাজ করে আর আমাদের দেশে রাজনীতিকরা সাধারণ মানুষকে নির্যাতন নিপীড়ন করে মানবাধিকার লঙ্গন করে। স্বাধীনতার পর থেকে যখন যে সরকার দেশ পরিচালনা করেছে প্রতিটি সরকারের শাসনামলে নিজ নিজ দলের অধিকার ও আধিপত্য বজায় রাখতে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে বিদেশে পাচার করে দেশকে দরিদ্র থেকে হতদরিদ্র বানিয়ে ছেড়েছে। একই পরিস্থিতি আমরা দেখেছি বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রশাসনিক দপ্তরের আমলা, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারি, ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রেও। বিগত সরকারের শাসনামলে দেশের অর্থনীতি ধ্বংসকারী মন্ত্রী-এমপিদের শায়েস্তার বদলে উল্টো সুযোগ সুবিধা দেওয়ার ফলে তারা দেশকে পঙ্গু বানিয়ে ফেলেছে। এসব মন্ত্রী, এমপি, আমলা, ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তারা একেকজন হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করে বিদশে পাচার করে সেখানে স্ত্রী, সন্ত্রানদের নিয়ে স্বর্গীয় সুখে বসবাস করছে। জবাবদিহিতার বালাই ছিলনা। সামান্য রাজনৈতিক কর্মিদের দাপটে আমাদের মতো মানুষদেরও তটস্থ হয়ে থাকতে হয়েছে। তাদের অহংকারীত্বের দম্ভে কথা বলা পর্যন্তও দুস্কর হয়ে পড়তো। নেতাকর্মিরা জায়গা-জমির দালালি, চাঁদাবাজি, বিচার-শালিসের নামে মানুষকে যে পরিমাণে হয়রানী করেছে তা ছিল এককথায় নজিরবিহীন। দেশের এমন কোনো রাষ্ট্রিয় প্রতিষ্টান নেই যেখানে দুর্নীতির বিস্তার ঘটেনি। প্রশাসনিক দপ্তরের একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারীর কারণে দেশের মেরুদন্ড নষ্ট হয়েগেছে।
মেরুদন্ড সুস্থতার জন্য সুচিকিৎসা প্রয়োজন। জটিল রোগে আক্রান্ত হয়েছে দেশ। সাধারণ মানুষকে বাঁচাতে হলে সর্বপ্রথম দেশ সংস্কারে নজর দিতে হবে। প্রয়োজনে নষ্ট অচল মাল ফেলে দিয়ে নতুনভাবে সংযোজন করতে হবে মানে বিভিন্ন সেক্টরে নতুনভাবে নিয়োগ দিয়ে দেশের সামগ্রিক অবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। তবেই হবে তারুণ্য আকাঙ্খার বাস্তব প্রতিফলন। আজকে তরুণরা এগিয়ে এসেছে বলে সর্বত্র পরিবর্তনের আভাস লক্ষ্য কারা যাচ্ছে। রাজনীতিকরা দেশকে পুঙ্গ করে ফেলেছে, ক্ষমতার দম্ভে তারা বেমালুম ভুলেগিয়েছিল পরিণতির কথা! লোভ আর সুখের রাজ্যে ভাসতে ভাসতে রাজনীতিগণ সাধারণ মানুষকে চুষে খেয়েছে। তারা যে সাধারণ মানুষের ঝাঁকুনিতে মুহুর্তে ভেসে যাবে কখনো কল্পনা করেনি। জনগণ হচ্ছে দেশের বড়ো শক্তি। এর ওপর আর কোনো শক্তি নেই। একবার ঝাঁকুনি দিলে অস্থিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। তার প্রমান আবারো দেখলাম। বিগত ২০০৬ সালের তত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও রাজনীতিকগণকে প্রচন্ড রকমের ঝাঁকুনি দিয়েছিল তৎকালীন তত্বাবধায়ক সরকার। তত্বাবধায়ক সরকার প্রধান বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক সফল গভর্ণর মননীয় ফখরুদ্দীন আহমদ এর সময় দেশকে অনেকটা সঠিক পথে নিয়ে এসেছিল। তখন সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন মেজর জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ। তখন সশস্ত্রবাহিনী দুর্নীতি প্রতিরোধে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সর্বাত্বক সহযোগিতা করেছিলেন। এমন কঠিন শাসন পরিচালনা করেছিলেন যে পরবির্তিতে তাদের নিয়ে অনেক রটনা রটিয়ে দিয়েছিলেন। তারা তখন বলেছিলেন এমন সরকার যাতে দেশে পুনঃ ফিরে আসতে না পারে তার জন্য আইনকে পরিতর্ন করা হবে। কিন্তু জনগণকে বাইরে রেখে কোনো আইন যে টিকে থাকে না সে কথা তারা ভুলে গিয়েছিলেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্র-জনতার মধ্যে দিয়ে তার বাস্তব প্রতিফলন দেখেছি। ফিরে এসেছে নির্দলীয় নিরপেক্ষ অন্তবর্তিকালীন সরকার। ছাত্র সমাজ জাগলে যে রাষ্ট্রের ভীত নড়বড় হয়ে যায়, সকল আইনকানুন পরিবর্তন হয়ে যায় সেটি আবারও বাংলার জনগণ।
বর্তমান অন্তর্বর্তি সরকারের কাছে সাধারণ মানুষের আকুল প্রার্থনা দেশের অর্থনীতি, রাষ্ট্রিয় সম্পদ ধ্বংসকারীদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে। আইন ও মানবাধিকার সুনিশ্চিত করতে হবে। সরকারকে একটি জ্ঞানভিত্তিক রাষ্ট্র পরিচালনার মধ্যে দিয়ে উন্নত সমৃদ্ধ দেশে রূপান্তর করার ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হলে দেশে শিক্ষাক্ষেত্রে আমুল পরিবর্তন সূচিত হবে। তবে ছাত্র আন্দোলন এবার আস্তে আস্তে থামতে হবে। যেকোনো বিষয় দেখলেই যে রাস্তায় নেমে আসতে হবে, প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে হবে তা কিন্তু নয় ! এরকম হলে আন্দোলনের ফল ভেস্তে যাবে। সুবিধাভোগীরা আবারো মাঠ দখলে নামবে। অতএব, শিক্ষার্থিদের ভেবেচিন্তে খুব সতর্কতার সহিত এগোতে হবে। ছাত্র সমাজকে বুঝতে হবে যে ব্যক্তিকে আপনারা অন্তর্বর্তি সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে পছন্দ করেছেন তিনি বাংলাদেশের সকল শ্রেণিপেশার মানুষের কাছে শ্রদ্ধেয়। সরকার প্রধান প্রফেসর ড. মুহম্মদ ইউনূস তিনি বিশ্বব্যাপী অত্যন্ত সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব বর্তমান সময়ে তাঁর কোনো বিকল্প হতে পারে না। এছাড়া উপদেষ্টা হিসেবেও যারা যোগ দিয়েছেন নবীন-প্রবীণের এই সমন্বয়কে দেশের সকল আপামর জনগণ স্বাগত জানিয়েছেন। দেশের মানুষ আর কোনোরকম অরাজকতা, নৈরাজ্য দেখতে চায় না। আমাদের দেশ আমরাই গরবো। দৃঢ় প্রত্যয়ে এগিয়ে যাবো। প্রিয় মাতৃভূমি ভবিষ্যতে আর যাতে কোনোভাবে বিপথে পরিচালিত না হয় অন্তর্বর্তি সরকারকে সে ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।