একজন দক্ষ শিক্ষাবিদ প্রতিভাবান সংগঠক, বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক কবি সাহিত্যিক গুণী ব্যক্তিত্ব একেবারে শান্ত ভদ্র নিরহংকারী সাদা মনের মানুষ চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজের সাবেক উপাধ্যক্ষ প্রফেসর সালমা রহমান। এসএসসি পাশ করেন চট্টগ্রামের খান বাহাদুর আব্দুল হক দোভাষ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে, এইচ.এস.সি পাশ করেন চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজ। বি.এস.এস (অনার্স) এবং এম.এস.এস (অর্থনীতি) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবন শুরু হয় ১৯৮৮ সাল থেকে প্রথম খাজা আজমেরী কেজি এন্ড হাইস্কুল সহকারী শিক্ষক হিসেবে পরবর্তীতে একই প্রতিষ্ঠানে অধ্যক্ষ হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। এরপর ১৯৯৩ সাল প্রভাষক পটিয়া সরকারি কলেজ, ২০০১ সাল চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজ সহকারী অধ্যাপক, একই প্রতিষ্ঠানে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন ২০০৮ সালে। ২০০৮ সালে আগস্ট মাসে বিভাগীয় প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন সাতকানিয়া সরকারি কলেজ। এর মধ্যে যুক্ত হন ২০১৮ সালে অধ্যাপক বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর, ঢাকা ( সংযুক্ত চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ)। ২০২১ সালের নভেম্বর হতে চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজে উপাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে অবসরে যান ২০২৩ সালের জুন মাসে। তিনি বিভিন্ন সংগঠনের সাথে ও যুক্ত রয়েছেন। স্লোগান সৃজনে আনন্দে নারী বিভাগ থেকে তাঁর মুখোমুখি হয়ে একান্ত আলাপচারিতায় জানার চেষ্টা করেছি তাঁর ব্যক্তিজীবন, শিক্ষকতা জীবন, সাংগঠনিক জীবন লেখালেখি ও নারীদের উত্তরণ এগিয়ে যাওয়া নিয়ে নানামুখী ভাবনা। ১৯৬৪ সালে কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার হিজলাবট গ্রামে তাঁর জন্ম। পিতা বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সমাজসেবক মরহুম হাফিজুর রহমান এবং মা মনোয়ারা বেগম। স্বামী মরহুম নূর মোহাম্মদ ব্যবসায়ী (মিরসরাই ইউনিয়ন)। মেয়ে ফেরদৌস আরা ডেপুটি ম্যানেজার (মিডিয়া) জিপিএইচ-এ কর্মরত। ইংরেজি সংবাদ পাঠক বাংলাদেশ বেতার চট্টগ্রাম। ছেলে মনিরুজ্জামান চৌধুরী একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। এই নিয়ে তার সাজানো পরিবার। ১৯৯০ সাল থেকে দৈনিক আজাদী, দৈনিক পূর্বকোণসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে লেখালেখির সাথে যুক্ত। এই পর্যন্ত তাঁর চারটি বই প্রকাশিত হয়েছে। আলাপের প্রথমেই জানতে চেয়েছি – শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হলেন কিভাবে? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, শিক্ষকতা পেশা আমার আশৈশব লালিত স্বপ্ন। খুব ছোট বয়সেই আমার খেলার একটা বড় অংশ ছিল টিচার সেজে বন্ধুদের পড়ানো, শিক্ষককে নকল করতে পারতাম। যখন একটু বড় হচ্ছি স্বপ্নটাও বড় হতে শুরু করেছে প্রাইমারি স্কুলের গন্ডি ছাড়িয়ে হাইস্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছি। আর স্বপ্ন ধরা দিয়েছিল মষ্টিার্স পরীক্ষার পর একটা বেসরকারি স্কুলে যোগদানের মাধ্যমে। এরপর ১৯৯৩ সালে বিসিএস পরীক্ষা পাশ করে শিক্ষা ক্যাডারে যোগদানের সুযোগ হয়। বলা যায় শিক্ষকতা আমার সারা জীবনের সাধনা। বর্তমানে কোন্ কোন্ সংগঠনের সাথে জড়িত আছেন? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি-আজীবন সদস্য, বিসিএস ঊইমেন নেটওয়ার্ক–আজীবন সদস্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই এসোসিয়েশন-আজীবন সদস্য, চট্টগ্রাম লেডিস ক্লাব–উপদেষ্টা, জান্নাত ফাউন্ডেশন-উপদেষ্টা, কুষ্টিয়া জেলা সমিতি চট্টগ্রাম-প্রাক্তন ঊপদেষ্টা, চট্টগ্রাম সরকারি মহিলা কলেজ প্রাক্তন ছাত্রী পরিষদ–সভাপতি, চট্টগ্রাম লেখিকা সংঘ-সহ সভাপতি, নারীকন্ঠ-সদস্য, গ্রাজুয়েট উইমেন ইন্টারন্যাশনাল- সদস্য। আপনি শিক্ষকতা, লেখালেখি, সাংগঠনিক দায়িত্ব, সংসার সবকিছু কিভাবে সামলিয়ে চলেন একটু জানতে চাই। এক্ষেত্রে টাইম ম্যানেজমেন্ট বিষয়টা সবচেয়ে জরুরি। আর আমি আমার পেশাগত কাজের সময়ে যত লোভনীয় বা পছন্দের বিষয় হোক না কেন কোথাও যায়নি। যেহেতু শিক্ষকতা আমার পেশা শতভাগ আন্তরিকতা, নিষ্ঠা ও সততার সাথে কাজ করেছি। আমার শিক্ষকতা শুধূ শ্রেণিকক্ষেই সীমাবদ্ধ ছিলনা–ডিবেট ক্লাব, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, জাতীয় দিবস পালন, বিজ্ঞান ক্লাবসহ সকল সহপাঠক্রম বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সাথে দীর্ঘ সময় কাজ করেছি। বেশির ভাগ দিন শেষ বেলায় কলেজ থেকে ফিরতাম। সাংগঠনিক কাজ সাপ্তাহিক ছুটির দিন বা কলেজ ছুটির পর করে থাকি। লেখালেখির কাজটা গভীর রাতে করতে পছন্দ করি, মনে হয় সে সময় আমার অনুভূতিগুলো ডালপালা মেলে। আর সংসারের কাজ সেতো প্রতিটা কর্মজীবি নারীর মতো কাকবিহানে ঘুম থেকে উঠা তারপর সব সামলিয়ে কলেজে বের হওয়া। আবার কাজ শেষে ঘরে ফিরলে সম্পূর্ণ হাউজওয়াইফ। সংসার জীবনে যারা আমার ঘরে সহযোগী হিসেবে কাজ করেছিল তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আমার মনে হয় সফল নারী কথাটা শুনতে যত সুন্দর শুনায় তা অর্জনের জন্য অনেক পরিশ্রম, অনেক ত্যাগ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ধৈর্য্যের।
আপনার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা কত? প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে ভাললাগার বই কোনটি? প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা চারটি, প্রকাশিত বই ১. নক্ষত্ররাজি ২.মনের মুকুরে ৩. আমার ১১১ দিন, ৪. নোনা জলের অনুভূতি বিষয়বস্তুর দিক থেকে প্রত্যেকটি আলাদা। যে কোন বই লেখা শ্রমসাধ্য ব্যাপার তাই প্রতিটি বইয়ের জন্য অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করে। তবে পাঠকপ্রিয়তার দিক থেকে আমি ধন্য হয়েছি এবং ভীষণ আনন্দ দিয়েছে স্মৃতিকথা ‘‘আমার ১১১১ দিন’’। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে বইটির সব কপি বিক্রি হয়ে গেছে। অনেক পাঠক মোবাইলে, ম্যাসেঞ্জারে সুন্দর সুন্দর অনুভূতি প্রকাশ করেছেন।
শিক্ষা, সাহিত্য, সাংস্কৃতিক চর্চার পাশাপাশি খেলাধুলায় নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে বিষয়টা কিভাবে দেখছেন? ফুটবল পায়ে নারীরা মাঠ কাঁপাবে, ক্রিকেট ব্যাট হাতে ছক্কা মারতে পারে, ভারোত্তোলনে বিশ্ব সেরা হতে পারে এক যুগ আগে আমরা ভাবতেও পারিনি। এছাড়া অন্যান্য খেলাতেও নারীরা সাফল্য বয়ে আনছে। দীর্ঘদিনের ধারণা ভেঙে ক্রীড়ায় নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে দুর্দান্ত গতিতে, আমি বিষয়টাতে অনেক আশাবাদী। নারী পুরুষের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের মাধ্যমে সমাজ এগিয়ে যায়, বিশ্বে দেশের নাম উজ্জ্বল হয়। নারী খেলোয়ারদের অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়, এজন্য পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষা আর সচেতনতা প্রয়োজন। এছাড়া রাষ্ট্রীয় পৃষঠপোষকতা খুব বেশি প্রয়োজন। নারীরা প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ পেলে তারা দেশের জন্য আরো সুনাম বয়ে আনবে এর প্রমাণ আমরা পেয়েছি।
পেশাগত জীবনে আপনার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি কি? পেশাগত জীবনে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মচারীদের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, বিশ্বাস–এই শক্তিতেই আরো বেশি ভাল কাজ করতে অনুপ্রাণিত হয়েছি। কর্মজীবনে আরো কিছু অমূল্য প্রাপ্তি ছিল যা এখনো স্বর্গ সুখ এনে দেয়, কিছু শিক্ষার্থী ছিল বিপথে যাওয়া, পড়ালেখায় একেবারেই অমনোযোগী অথবা এমনি দারিদ্রতার কারণে বন্ধ হওয়ার উপক্রম তাদেরকে কাউন্সেলিং করে, নানাভাবে সহযোগিতা করে আলোর পথে ফিরিয়ে এনেছি। আজ তারা সমাজে প্রতিষ্ঠিত, অনেক দিন পরও তারা যখন আমাকে দেখতে আসে সেই প্রাপ্তি অন্য কিছুর সাথে তুলনা করা যায়না। তবে আমার এ কাজে কিছু সহকর্মী সব সময় সহযোগিতা করেছে বই দিয়ে, আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে তাদেরকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।
নারী পুরুষ মিলেমিশে কাজ করতে আপনি কি কখনো কোন অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছেন? নারী পুরুষ একসাথে কাজ করতে নানা অসুবিধা ও অপ্রিয় বিষয় ঘটে থাকে এটা আমরা প্রায়ই দেখতে পাই। অনেক মেয়ের কর্মজীবন বিষময় হয়ে উঠে। যেহেতু আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাওয়া হয়েছে সেক্ষেত্রে বলবো আমি সেই সৌভাগ্যবানদের একজন যে ৩৫ বছর শিক্ষকতার জীবনে পুরুষ সহকর্মীদের পূর্ণ সহযোগিতা ও সম্মান পেয়েছি। সিনিয়রদের কাছে পেয়েছি সন্তানসম ¯েœহ, সমবয়সীরা ছিলেন আমার সহযোদ্ধা ভাই, জুনিয়রদের কাছে পেয়েছি অসীম শ্রদ্ধা। নারীরাও মানুষ সেও নিজের মতো বাঁচার অধিকার রাখে এই বিষয়ে একটু বলবেন- প্রশ্নের প্রথম অংশ নারীরাও মানুষ শত বাধা সত্তে¡ও সেই আত্বোপলব্ধি নারীর নিজের ভেতরে থাকতে হবে। সামাজিক অনেক প্রতিকূলতা সত্তে¡ও নারীরা আজ শিক্ষায় এগিয়ে গেছে, পোশাকে, সৌন্দর্য চর্চায় তারা যথেষ্ট সচেতন। কিন্তু যে জায়গায় আমার কাছে ঘাটতি মনে হয় তা হচ্ছে এ প্রজন্মের বেশির ভাগ মেয়ে লক্ষ্য স্থির করতে জানেনা আর খুব তাড়াতাড়ি সব পেতে চায়। মেয়েরা এগিয়ে যাওয়ার পথে বহুমাত্রিক সমস্যা রয়েছে সেজন্য মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে নারীকে অত্যন্ত দৃঢ়চেতা ও আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন হতে হবে। এবার আসি নিজের মতো বাঁচার অধিকার প্রসঙ্গে, সত্যি কথা বলতে কি পরিবারে, সমাজে নারী পুরুষ কেউই নিজের মতো বাঁচতে পারেনা-আমার মনে হয় পারা উচিতও নয়। কারণ প্রতিটা মানুষের সাথে আরো কতগুলো মানুষ প্রত্যক্ষভাবে জড়িত এদের ভাল-মন্দ, সুখ-দুঃখ মাথায় রেখে পথ চলতে হয়। তবে নারীর যে অধিকারটুকু অপরিহার্য তা হচ্ছে তার কাজের স্বীকৃতি ও মূল্যায়ন। কাজের ফাঁকে সে যেন প্রয়োজনীয় বিশ্রামটুকু পায়, দিনশেষে সে যেন আপন মনে গুনগুনিয়ে উঠতে পারে, তার পছন্দের কোন বিষয় যেন চর্চা করতে পারে, পরিবারের কারো কথা বা ব্যবহারে নারী যেন অসম্মানিত না হয়। এ প্রসঙ্গে মীনাক্ষী দাসের নারী কবিতার কিছু অংশ মনে পড়ে গেল—–
তুমি আকাশখানা খুলে দিতেই
মেলে দিলাম ডানা-
যেইনা আমি উড়তে গেলাম
করলে জরিমানা
তুমি চাওনা আমি উড়তে শিখি
চাওনা সাঁতার কাটি
চাওনা আমি তোমার সঙ্গে
পা মিলিয়ে হাঁটি–
সব কিছুতে না এ অবস্থা থেকে নারী মুক্তি পাক। সবচেয়ে বড় কথা নারী যে পরিবারের অপরিহার্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সকল কাজে, সকল সিদ্ধান্তে তা মনে রাখতে হবে। নারী এগিয়ে যাক, সমাজ এগিয়ে যাক, সেই সথে এগিয়ে যাক দেশ।