খাগড়াছড়ির রামগড় ও পাশ্ববর্তী পাহাড়ি সীমান্ত এলাকায় চোরাকারবারিদের অপতৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন ভারতীয় পণ্য পাচারের ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে রামগড় ও পাশের বনজঙ্গল ঘেরা পাহাড়ি টিলা-উপত্যকা। ফলে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে। রামগড় ৪৩,বিজিবি’র চোরাচালান বিরোধী চলমান অভিযান দুর্বৃত্ত্বদের দমাতে পারেনি। কিছুদিন গাঁঢাকা দেওয়ার পর আবার পূর্ণোদ্যমে শুরু করে তাদের অশুভ কর্মকান্ড। ভারতীয় বিভিন্ন পণ্য সীমান্ত পেরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নানা গন্তব্যে। জানতে চাইলে, রামগড় উপজেলা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কমিটির প্রধান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মমতা আফরিন বলেন, সীমান্ত এলাকা দেখভালের দায়িত্ব বিজিবির। রামগড় ৪৩,বিজিবির জোন কমান্ডারের সঙ্গে (সিও) এ বিষয়ে কথা বলব। বিভিন্ন সূত্র জানায়, কয়েকটি সংঘবদ্ধ চোরাকারবারি দল দীর্ঘদিন ধরে রামগড়, রামগড় লাগোয়া মাটিরাঙা, উত্তর ফটিকছড়ি ও মীরসরাইয়ের পাহাড়াঞ্চল ( এই পুরো এলাকা রামগড় ৪৩,বিজিবির অধীন, প্রায় ৩০ কিলোমিটার সীমান্ত) এবং ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের দক্ষিণ ত্রিপুরার সাবরুম ও তৎসংলগ্ন সীমান্ত অঞ্চলে তাদের অপতৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। এ এলাকা দিয়ে অবাধে ভারতীয় মালামাল পাচার হচ্ছে। সীমান্তের শূন্য রেখায় প্রবাহিত ফেনীনদীটিই মূলত: দুইদেশের বিভাজন রেখা। চোরাচালানের সুবিধার জন্য দুর্বৃত্তরা স্থানে স্থানে ভারতীয়দের দেওয়া কাঁটাতারে বেড়া কেটে নেয় । এতে নির্বিঘ্নে মালামাল আনা-নেওয়া যায়। এদিকে, রামগড় বিজিবি ১২,জুন কয়লা সীমান্ত থেকে ৪৬ বোতল ভারতীয় মদ জব্দ করে। ৯, জুন রামগড় থানা পুলিশ ৯০০ প্যাকেট আতশবাজি জব্দ করে। ২৩,মে কয়লা সীমান্ত থেকে ২টি ভারতীয় গরু আটক করে বিজিবি। ২০,মে এক কেজি গাঁজা ও ৫০ পিচ ইয়াবা জব্দ করে বিজিবি। ১৮,মে ৪৮ বোতল মদ জব্দ রুহুল আমিন চর থেকে। ১৪,মে ৪২ বোতল ভারতীয় মদ কয়লা মুখ থেকে। ১২, মে নলুয়া থেকে ৪টি গরু আটক করে। ৮, মে বিজিবি কয়লামুখ থেকে ১৫কেজি গাঁজা ও ১,মে ১১৫ বোতল ভারতীয় মদ জব্দ করে বাগান বাজার থেকে। রামগড় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দেবপ্রিয় দাশ বলেন, জনগণের সহযোগিতা ছাড়া পুলিশের পক্ষে একা চোরাচালান বন্ধ করা সম্ভব নয়। ভারতীয় গরু রামগড় চা বাগান হয়ে হয়ত আসছে । রামগড় বাজারের বাসিন্দা অধ্যক্ষ ফারুকুর রহমান বলেন, সারা বছর এ এলাকা দিয়ে চোরাচালান হয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে যেন আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। চোরাকারবারিরা বেপরোয়াভাবে তাদের অবৈধ কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। রামগড় ও তৎসংলগ্ন পাহাড়ি সীমান্ত দিয়ে অবৈধ মালামাল পাচার হয়। সূত্র জানায়, চোরাচালানিরা মূলত রামগড় লাগোয়া বাগানবাজার, নলুয়া, আঁধারমানিক, রামগড় চা বাগান, মোহাম্মদপুর, করলিয়া, কয়লারমুখ, ও পানুয়া সীমান্ত এলাকা এবং রামগড় পার্বত্যাঞ্চলের সোনাইপুল, মহামুনি, দারোগাপাড়া বল্টুরাম, বৈষ্ণব পাড়া, কাশিবাড়ি লাছাড়িপাড়া সীমান্ত এলাকায় অবাধে পণ্য পাচার করছে। এছাড়া বিভিন্ন প্রকার মাদকদ্রব্য ও নারী-শিশু পাচার হয় সীমান্ত দিয়ে। ইতিপূর্বে বেশ কয়েকবার অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে বিজিবি ও বিএসএফ উভয় দেশের বেশকয়েকজন মানুষ আটক করে।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, রাতে অবৈধ মালামাল ভর্তি মিনিট্রাক,সিএনজি চালিত অটোরিকশা ও বিভিন্ন যানবাহন চলাচল করে। কালেভদ্রে ২/১জন বাহক ধরা পড়লেও রাঘববোয়ালরা থেকে যায় আড়ালেই। পাচারকারীরা সীমান্তের ওপার থেকে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মাদক, ভারতীয় শাড়ি, থ্রি পিচ, লেহেঙ্গা, চাপাতা,গাঁজা,ইয়াবা বড়ি, মোটরসাইকেল, মোবাইল ফোন সেট,বাইসাইকেল, চিনি, মসলা ও স্টিলের সামগ্রী, বৈদ্যুতিক পাখা, টিভি যন্ত্রাংশ, বিভিন্ন প্রশাধনী দ্রব্য, আতশবাজি, পাউডার দুধ, ফেনসিডিল, বিভিন্ন ধরনের ওষুধ , যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট, নানা প্রকারের কীটনাশক বাংলাদেশে চালান দেয়। মাছ, রেডিমেইড ফার্নিচার, বিদেশী ব্র্যান্ডের সিগারেটসহ নানা পণ্য ভারতে পাঠানো হয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে গরু,মাদক ও কাপড় বাংলাদেশে আসছে বলে সীমান্ত সূত্রে জানা গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বেশ কয়েকটি রুটে ভারতীয় পণ্য পাচার হয়।
এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রামগড় উপজেলার পিলাক–লাছাড়ি পাড়া বনবিহার হয়ে বৈদ্যপাড়া-বাজারচৌধুরী পাড়া– দাঁতারামপাড়া–নাকাপা হয়ে থলিবাড়ি–জালিয়াপাড়া দিয়ে চট্রগ্রাম। ছিনছড়িপাড়া–কৈলাশপাড়া– তৈচাকমা এলাকা হয়ে হেয়াকো–ফটিকছড়ি। রামগড় সোনাইপুল ফরেস্ট গেইট হয়ে বাগানবাজার–হেয়াকো ফটিকছড়ি । রামগড় বৈষ্ণবপাড়া কাশিবাড়ী সীমান্ত — বল্টুরামটিলা–সন্দীপ টিলা–গর্জনতলী–কৈলাশপাড়া হয়ে জালিয়াপাড়া। এর বাইরেও নানা রুটে ভারতীয় পণ্য পাচার হয়। এলাকার সোনাইপুল বাজারে একটি পরিচিত কাপড়ের দোকানে রামগড় থেকে নিয়মিত ভারতীয় শাড়ির চালান যায়। রামগড়ের একটি সিন্ডিকেট অবৈধভাবে ভারত থেকে শাড়ি নিয়ে আসে। এজন্য আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাকে মাসোয়ারা দেয়। কোরবানি ঈদকে সামনে রেখে প্রতিবছরই কম-বেশি ভারতীয় গরুর চালান আসে সীমান্ত পেরিয়ে। চিকনছড়া ও বাগান বাজার বড়ধরনের গরুর হাট বসে। রামগড়ের বাসিন্দা আবদুল মোমেন জানান, অবৈধভাবে ভারতের গরু আসলে সরকারের রাজস্ব হারানোর পাশাপাশি স্থানীয় ভাবে উৎপাদিত পশুর দাম কমে যায়। এতে ক্ষতিগ্রস্থ হয় গরু লালন-পালনকারী ক্ষুদ্র চাষিরা। অধ্যক্ষ ফারুকুর রহমান বলেন, বাগান বাজার , আধার মানিক , কয়লামুখ, লক্ষ্মীছড়া ও লাছাড়িপাড়া সীমান্ত হয়ে গরুর চালান সহ বিভিন্ন ধরনের ভারতীয় মালামাল বাংলাদেশে ঢুকে বলে শুনেছি । পরে এগুলো বিভিন্ন রুট হয়ে পৌঁছে যায় নির্দিষ্ট গন্তব্যে। রামগড়ের ফেনীরকুল এলাহী বক্স চৌধুরী ডেইরী ফার্মের স্বত্বাধিকারী মাসুদ আলম চৌধুরী জানান, চোরাই গরুর কারণে লাভক্ষতির হিসাব কষতে ক্ষতির অংশই বেশি দেখা যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বিজিবি খাগড়াছড়ির গুইমারা সেক্টর ( রামগড় ৪৩, ব্যাটালিয়ন, যামিনী পাড়া ২৩,ব্যাটালিয়ন ও খেদাছড়া ৪০ ব্যাটালিয়ন) কমান্ডার কর্নেল এস,এম আবুল এহসান বলেন, চোরাচালান দমনে সীমান্তে বিজিবি সদস্যরা অত্যন্ত তৎপর। কোন অবস্থাতেই চোরাই গরু বাংলাদেশে আসতে দেওয়া হবে না। এতে দেশীয় খামারিরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। মাদকের বিষয়ে বিজিবি শূণ্য সহনশীলতার নীতিতে কঠোর অবস্থানে রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।