শনিবার, ২৫ জানুয়ারি ২০২৫
spot_img

বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার উৎসব পহেলা বৈশাখ

মহসিনা মিতু

বাংলা নববর্ষ বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধান জাতীয় ও সার্বজনীন উৎসব। দীর্ঘকাল ধরে নববর্ষ পালনের বাঙালি সংস্কৃতিটি একটি অসাম্প্রদায়িক উৎসব হিসাবে পালিত হয়ে এসেছে। ঐতিহাসিক আঙ্গিকে বৈশাখের উৎস অন্বেষণে জানা যায় ,নববর্ষকে নির্দিষ্ট করতে ভূমিকা রেখেছিলেন মোগল সম্রাট আকবর। মোগলদের রাজস্ব আয়ের একটি বড় অঞ্চল ছিল বাংলা। তৎকালীন জমিদারদের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় করা হতো। বাংলায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছিল নৈমিত্তিক ব্যাপার। বন্যা, ঝড়, খরায় প্রায়ই ফসলহানি ঘটত। এমন বিপর্যয় ঘটলে প্রজা এসে নিবেদন করত খাজনা মাফ করার জন্য। বাস্তব অবস্থা মেনে মোগল দরবারে জমিদার প্রকৃত তথ্য জানাতেন। এতে সংকট হলো মোগল অর্থনীতিতে। তাই সম্রাট আকবর তার বিখ্যাত অর্থমন্ত্রী রাজা টোডরমলকে এ সমস্যার সমাধান করার দায়িত্ব দিলেন। টোডরমল বাংলার প্রকৃত অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারলেন বছরের যে সময় কৃষকের গোলায় কমবেশি ফসল উঠবে, তখন যদি খাজনা পরিশোধের দিনক্ষণ ঠিক হয়, তাহলে প্রজার খুব বেশি কষ্ট হবে না খাজনা দিতে।এই বিবেচনায় তিনি বাংলা ক্যালেন্ডার প্রস্তুত করলেন, যা পরবর্তীতে বঙ্গাব্দ নামে পরিচিত হয়। ফসলের সঙ্গে এ দিনপঞ্জি সম্পর্কিত বলে সূচনায় ফারসি উচ্চারণে বাংলা সনের নাম হয়েছিল ‘ফসলি সন’। ফসলি সনের প্রথম মাসটি ছিল বৈশাখ। তাই সঙ্গত কারণেই পহেলা বৈশাখ হয়ে গেল ফসলি সনের প্রথম দিন অর্থাৎ বাঙালি নববর্ষের প্রথম দিন।নববর্ষে আনন্দ উৎসব যুক্ত হওয়া ছিল স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
ইসলামের গোড়াপত্তন অর্থাৎ মহানবির আমল থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে আরবে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের বিষয়টি জানা থাকার কথা নয়। তাই জোর করে এ সাথে ধর্ম যুক্ত করা ধর্মকে সংকীর্ণভাবে উপস্থাপন করার নামান্তর। বাঙালির নববর্ষ পালনে নানা আনুষ্ঠানিকতা যুক্ত হওয়ার পেছনেও ইতিহাস রয়েছে। ফসলি সনে প্রজা যাতে উৎসাহের সঙ্গে খাজনা দিতে পারে, তার একটি যৌক্তিক পটভূমি নির্মাণ করেছিলেন জমিদাররা। সে যুগে খাজনা হিসাবে নেওয়া হতো উৎপাদিত ফসলের নির্দিষ্ট অংশ পহেলা বৈশাখের দিন বা আগের দিন অর্থাৎ চৈত্রসংক্রান্তির দিন খাজনা পরিশোধের তারিখ নির্দিষ্ট ছিল। এদিন প্রজারা খাজনার ফসল নিয়ে আসতেন জমিদারের দপ্তরে। সেদিন উৎসবের আয়োজন করতেন জমিদার। এ উৎসবের নাম ছিল ‘পুণ্যাহ’। প্রজাদের মিষ্টি খাওয়াতেন জমিদার। প্রজাদের জন্য বিশেষ যাত্রাপালার আয়োজন হতো নাটমন্দিরে। এভাবে জমিদাররা সামাজিক মিলনের ব্যবস্থা করেছিলেন। একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ তৈরি হতো। এ পথ ধরেই নববর্ষ বাঙালি জীবনে একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনার জন্ম দেয়।নববর্ষে ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ‘হালখাতা’র রেওয়াজ শুরু করে। পহেলা বৈশাখে হিন্দু ব্যবসায়ী দোকান সাফসুতরো করেন। পুরোহিত পূজাঅর্চনা করে দিনের শুভ সূচনা করেন। পরে মিষ্টি বিতরণ করা হতো। একইভাবে মুসলমান ব্যবসায়ী দোকান পরিষ্কার করে মিলাদ পড়িয়ে মিষ্টি বিতরণ করেন। হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের ব্যবসায়ীরা সম্মিলিত ভাবে এ উৎসবপালন করেন বহুকাল ধরে।এসব আনুষ্ঠানিকতা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে যুগ যুগ ধরে। এভাবে বাংলা নববর্ষ উদযাপনকে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিতে না দেখে একটি ঐতিহাসিক সংস্কৃতি হিসাবে মানা প্রয়োজন। এখানে বিশেষ কোনো ধর্মসম্প্রদায়ের সংস্কৃতির প্রতিফলন নেই, বরঞ্চ এর পুরোটাই সম্প্রদায় নির্বিশেষে একটি অভিন্ন বাঙালি সংস্কৃতির পরিচায়ক।

পহেলা বৈশাখ নিয়ে ভাষাসংগ্রামী ও রবীন্দ্রগবেষক আহমদ রফিক বলেছেন, ‘আমাদের এখানে ধর্মনিরপেক্ষ আর কোনো জাতীয় উৎসব নেই।অসাম্প্রদায়িকতার দিক থেকে বিবেচনা করলে পহেলা বৈশাখ অধিক গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতিগতভাবেও বৈশাখ গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে ফসলি মাস, অন্যদিকে কালবৈশাখি। সব মিলিয়ে বৈশাখ উদ্দীপনামূলক এক মাস, যা আমাদের জীবনে নতুন মাত্রা যোগ করে।’ ১৯৮৬ সালে যশোরের চারুপীঠ নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্রথমবারের মতো নববর্ষ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন করে। যশোরের সেই শোভাযাত্রায় ছিল – পাপেট, বাঘের প্রতিকৃতি, পুরানো বাদ্যযন্ত্রসহ আরো অনেক শিল্পকর্ম। শুরুর বছরেই যশোরে শোভাযাত্রা আলোড়ন তৈরি করে। পরবর্তীতে ১৯৮০’র দশকে স্বৈরাচারি শাসনের বিরূদ্ধে সাধারণ মানুষের ঐক্য এবং একইসঙ্গে শান্তির বিজয় ও অপশক্তির অবসান কামনায় যশোরের শোভাযাত্রার আদলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের উদ্যোগে ১৯৮৯ সালে সর্বপ্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রবর্তন হয়। ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো এ শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দেয়।
ঢাকায় বছরের প্রথম দিন শুরু হয় রমনা বটমূলে ছায়ানটের আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দিয়ে। সারা দেশের আনাচে- কানাচে নিজস্ব নিয়ম বা ঢংয়ে শুরু হয় এই বৈশাখ উদযাপন। চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে বের হয় প্রত্যেক বছর মঙ্গল শোভাযাত্রা। দিনভর সব জায়গায় থাকে উৎসব মুখর পরিবেশ, সাথে থাকে অনেক জায়গায় মেলা এবং ছোট ছোট উৎসব। গ্রামগঞ্জেও চলে নানা রকম মেলা, যাত্রা, গানের আয়োজন। বসে নানা রকম পসরা। হরেক রকম মিষ্টি, বাতাসা, মুড়কি, নিমকি, ইত্যাদি। বসে চরকি, নাগরদোলা, বায়োষ্কোপ আরও অনেক রকম মজার সব খেলা। গ্রামে সেই সাথে যুক্ত হয় বলী খেলা, নৌকা বাইচ। এই ধরনের বৈশাখী মেলা চলে পুরো মাসব্যাপী, সেই সাথে থাকে নানা রকম বৈশাখী আয়োজন। গ্রাম বাংলার পালা পার্বণ থেকে শহরের পালা পার্বণ কিছুটা ভিন্ন। শহরের বৈশাখী আয়োজনগুলো আবার একটু ভিন্ন আঙ্গিকের হয়। ঢাকা শহরে পহেলা বৈশাখের আগের দিন আয়োজন করা হয় চৈত্র সংক্রান্তি, যেখানে সন্ধার পর চারুকলার বটতলায় বসে নানা আয়োজন। চলে নাচ, গান, আবৃত্তিসহ আরও অনেক কিছু। এছাড়াও সংসদে ভবনের সামনে মানিক মিঞা এভিনিউতে রাতভর আঁকা হয় আলপনা। আলপনায় ফুটিয়ে তোলা হয় বৈশাখের পটভূমি।
নতুন বছরের প্রথম দিন এবং বিদায়ী বছরের শেষদিনকে ঘিরে নানা ধরণের আয়োজন ছুঁয়ে যায় সকল বাঙালিকেই। রাষ্ট্র ও সমাজের সকল স্তরের মানুষের যেমন পহেলা বৈশাখের উৎসবের সঙ্গে থাকে গভীর যোগসূত্রতা, তেমনই ধর্মনিরপেক্ষতা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্দিপিত হয়ে সকল সম্প্রদায়ের, জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা এ উৎসবে শামিল হন। বাঙালির ঘরে, জনজীবনে এবং আর্থ সামাজিক সংস্কৃতিতে এরকম উৎসব দ্বিতীয়টি নেই।

এই বিভাগের সব খবর

টেকনাফে অপহৃত শিশুসহ ১৫ জন উদ্ধার, ২ অপহরণকারী আটক

জেলার টেকনাফের বাহারছড়ার গহীন পাহাড় থেকে ছয় শিশুসহ অপহরণের শিকার ১৫ জনকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। এসময় অপহরণকারী চক্রের দুই সদস্যকে আটক করা হয়। উদ্ধার হওয়া...

রাউজানে নামাজে যাওয়ার পথে ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা

রাউজানে মো. জাহাঙ্গীর আলম (৫৮) নামে এক ব্যবসায়ীকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। আজ শুক্রবার দুপুর ১টায় বাইক নিয়ে মসজিদে যাওয়ার পথে রাউজান উপজেলার...

অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার প্রক্রিয়ার ওপর গুরুত্বারোপ অধ্যাপক ইউনূসের

বাংলাদেশের নাগরিকরা যেন কোনো বাধা বা হুমকি ছাড়াই অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে নির্বাচনে ভোট দিতে পারেন সেই প্রক্রিয়া তৈরি করার ওপর জোর দিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের...

সর্বশেষ

টেকনাফে অপহৃত শিশুসহ ১৫ জন উদ্ধার, ২ অপহরণকারী আটক

জেলার টেকনাফের বাহারছড়ার গহীন পাহাড় থেকে ছয় শিশুসহ অপহরণের...

রাউজানে নামাজে যাওয়ার পথে ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা

রাউজানে মো. জাহাঙ্গীর আলম (৫৮) নামে এক ব্যবসায়ীকে প্রকাশ্যে...

অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার প্রক্রিয়ার ওপর গুরুত্বারোপ অধ্যাপক ইউনূসের

বাংলাদেশের নাগরিকরা যেন কোনো বাধা বা হুমকি ছাড়াই অবাধ...

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি বিশ্বব্যাংকের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত

বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আন্না বিয়ার্দে বাংলাদেশ পুনর্গঠনে অন্তর্বর্তী সরকারের...

সুপার সিক্সে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ভারত ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ

নারী অনূর্ধ্ব-১৯ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সুপার সিক্সে ভারত ও ওয়েস্ট...

বিশ্বের দুই বৃহত্তম বন্দর পরিচালনা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে বড় বিনিয়োগে আগ্রহী

বিশ্বের দুই বৃহত্তম বন্দর পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান, ডিপি ওয়ার্ল্ড ও...