বাংলাদেশের প্রতিবেশী পরিচয় ছাপিয়ে মিয়ানমার আমাদের নিকট একটি অস্বস্তির নাম।গায়ের জোরে একটি জাতিগোষ্ঠীকে নিজ দেশের পরিচয় থেকে বঞ্চিত করেই ক্ষান্ত দেয়নি,এমনই অত্যাচারের স্টিমরোলার চালিয়েছে শাসক গোষ্ঠী,জীবন বাঁচাতে যে যেভাবে পেরেছে জীবন নিয়ে পালিয়ে শতকরা নব্বই শতাংশ মানুষ এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। হ্যাঁ,”রোহিঙ্গা” জনগোষ্ঠীর কথাই বলছি।
বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানবিকতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে সেই সময়ে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে সাময়িক আশ্রয় দিয়েছিলেন।আন্তর্জাতিক বিশ্ব ও জাতিসংঘের মাধ্যমে একটি ফলপ্রসূ সমাধান শেষে আশ্রিত রোহিঙ্গারা ফিরে যাবে নিজেদের দেশে এটাই ছিলো প্রত্যাশীত।কিন্তু দিন,মাস বছরের পর বছর পেড়িয়ে গেলেও রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া এগুতে পারেনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।এর পেছনে এক হলো, বৈশ্বিক পরিস্থিতি সেই সুযোগ দিচ্ছেনা,আর দুই হলো, মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন জান্তা সরকার খোদ নিজেরাই অস্তিত্ব সংকটে পড়তে চলেছে।
অবিশ্বাস্য শোনালেও মিয়ানমারের বাস্তবতা এখন এমটাই।বছরের পর বছর ধরে বিবদমান জাতিগোষ্ঠী আজ জান্তার বিরুদ্ধে এক হয়ে লড়াই করছে।যার ফলাফল হলো,ইতিমধ্যে মিয়ানমারের ৪৩ শতাংশ এলাকা সেনাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে বিদ্রোহীরা।
বিবিসি ও এএফপি মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে গত দুই দিন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।কি আছে সেই প্রতিবেদনে,চলুন দেখে আসি। স্বাধীনতার পর থেকে সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সংঘাত চলমান থাকলেও, এবারের সংকট সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে দেশটির জান্তা বা সামরিক শাসকরা।বিশেষ করে অন্য সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সমর্থন নিয়ে সরকারের বিরোধিতা করা শান রাজ্যের তিনটি জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীর একজোট হয়ে চালানো একের পর এক হামলা সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে ক্ষমতায় থাকা দেশটির সামরিক বাহিনী। বিদ্রোহী বাহিনীর কাছে প্রদেশ হারানো ও প্রতিবেশী দেশে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সদস্যদের পালিয়ে আশ্রয় নেবার খবর প্রতিদিনই উঠে আসছে গণমাধ্যমে। কেন এই সংঘাত? ১৯৪৮ সালে মিয়ানমার স্বাধীন হবার পর থেকেই সে দেশে সংঘাত চলছে।১৯৬২ সালে দেশটির ক্ষমতা দখল করে সামরিক বাহিনী।এরপর দীর্ঘ সময় ধরে জান্তা বাহিনীর হাতে ক্ষমতা থাকলেও ২০১৫ সালের এক নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি),যার নেতৃত্বে ছিলেন নোবেল বিজয়ী অং সান সু চি। তবে ২০২০ সালের নির্বাচনে দলটির ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা সামরিক শাসকদের কাছে হুমকি মনে হওয়ায় পরের বছর,অর্থাৎ ২০২১ সালের পয়লা ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আবারও ক্ষমতা নিজেদের দখলে নেয় সামরিক বাহিনী। তবে এই সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি দেশটির সাধারণ জনগণ। প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এলে কঠোর হাতে তাদের দমন শুরু করে সামরিক বাহিনী। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী,অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী সারা দেশে ক্র্যাকডাউন চালায়।এতে ১৬ হাজারেরও বেশি গণতন্ত্রকামী মানুষকে নির্বিচারে গ্রেফতার এবং পুলিশ হেফাজতে ২৭৩ জনের মৃত্যুর তথ্য উঠে এসেছে।এছাড়াও গণহত্যা,গ্রেফতার, অমানুষিক অত্যাচার,যৌন সহিংসতা সহ অন্যান্য নিপীড়নের কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। দখল হারাচ্ছে সামরিক বাহিনী:- বিদ্রোহী গোষ্ঠীর হামলার মুখে চলতি বছরের প্রথম সপ্তাহেও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পশ্চাদপসরণ অব্যাহত রয়েছে।দেশটির থিংক ট্যাংক ইন্সটিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি এন্ড পলিসি (আইএসপি) মিয়ানমারের তথ্য অনুযায়ী,সামরিক বাহিনী এরই মধ্যে বিদ্রোহী বাহিনীর কাছে ৪৩ শতাংশেরও বেশি জায়গা হারিয়েছে। থাইল্যান্ড ভিত্তিক মিয়ানমারের সংবাদ মাধ্যম ইরাবতীতে চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারিতে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী,সামরিক বাহিনী এর মধ্যে সারা দেশে ৩৩টি শহরের দখল হারিয়েছে,যা নিয়ন্ত্রণ করছে বিদ্রোহী বাহিনীর সদস্যরা।এর মধ্যে চিন, সাকাই, কিয়াং প্রদেশ এবং উত্তরাঞ্চলের শান এবং শিন রাজ্য উল্লেখযোগ্য।
অক্টোবরে হামলা শুরু হবার পর থেকে হাজার হাজার সৈন্য তাদের সরঞ্জাম নিয়ে বিদ্রোহী বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।সারা দেশে বিদ্রোহী বাহিনীর কাছে সেনাবাহিনী ৪০০ও বেশি সীমান্ত চৌকি হারিয়েছে। এর মধ্যে সামরিক বাহিনীর আঞ্চলিক কার্যক্রম চালানোর অফিসও রয়েছে। এদিকে রাস্তায় অতর্কিত হামলা থামাতে ব্যর্থ সামরিক বাহিনী তাদের সীমিত সংখ্যক হেলিকপ্টারের উপর নির্ভর করে ঘাঁটিগুলোতে রসদ পাঠাচ্ছে। তবে তাতেও শেষ রক্ষা হচ্ছে না। এই মাসে সামরিক বাহিনীর একটি হেলিকপ্টার এবং একটি যুদ্ধ বিমান গুলি করে ভূপাতিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে কাচিন রাজ্যের বিদ্রোহীরা।
সংকট বাড়ার কারণ কী? ইতিপূর্বে দেশটির অভ্যন্তরে বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে গৃহযুদ্ধ চলমান থাকলেও এবারের সংকট নজিরবিহীন।বিবিসি বার্মিজ সার্ভিসের অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর আয় থু সানের মতে,মিয়ানমারের সংকট গভীর হবার প্রধান কারণ অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে জনসাধারণের সক্রিয় প্রতিবাদ।গোষ্ঠীগুলো আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানে অনাগ্রহকে সংকট গভীর হবার দ্বিতীয় কারণ হিসেবে মনে করেন আয় থু সান।তিনি জানান,শান্তি আলোচনার জন্য সামরিক বাহিনী কিংবা বিদ্রোহী বাহিনীর কেউই এখনও পর্যন্ত প্রস্তুত না। অন্য সময়গুলোতে কোনও সংকটের সমাধানে সাধারণত সেনাবাহিনীর প্রধানই অপর পক্ষকে গোলটেবিল বৈঠকে ডেকে থাকেন।তবে এবার তেমনটা দেখা যায়নি। সামরিক শাসক মিন অং হ্লাইং বলেছেন,সন্ত্রাসী গোষ্ঠী’গুলোর সঙ্গে কোনও ধরনের আলোচনায় যেতে তিনি রাজি নন।তার এই ধরনের মনোভাবের কারণে আলোচনা শুরুই করা যায়নি। অন্যদিকে সামরিক জান্তা-বিরোধী বিদ্রোহী গোষ্ঠীও সাফ জানিয়ে দিয়েছে যে কোনোভাবেই তারা সামরিক শাসকদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি না। ফলে সামরিক শাসকের ক্ষমতা ছেড়ে দেয়া ছাড়া এই সংকট নিরসনের কোনও সুযোগ আপাততঃ দেখা যাচ্ছে না বলে মনে করছেন মি. সান। ২০১৫ সালে গণতান্ত্রিক উপায়ে এনএলডি ক্ষমতায় এলেও দেশের ওপর সার্বিক ক্ষমতা ছিল না দলটির।
আর তার কারণ ২০০৮ সালের সংবিধান।এই সংবিধান অনুযায়ী,দেশটির সংসদের অন্তত ২৫ শতাংশ আসন সামরিক বাহিনীর জন্য বরাদ্দ থাকবে।একই সঙ্গে কোনও আইন পাস করতে হলে অন্তত একজন সামরিক সদস্যের সম্মতি থাকতে হবে। অভ্যুত্থানের পরে এসকল সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত ক্ষমতা ছাপিয়ে সম্পূর্ণ ক্ষমতা সামরিক শাসকের হাতে চলে যায়।তবে ‘পিপল ডিফেন্স ফোর্স’ তৈরি হবার ফলে সামরিক বাহিনীর জন্য চ্যালেঞ্জ অনেকখানি বেড়ে যায়। সব গোষ্ঠীর সমন্বয়ে তৈরি করা ‘পিপল ডিফেন্স ফোর্সে’ অংশ নেয় জনসাধারণ।সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে থাকা সশস্ত্র বিদ্রোহীদের সঙ্গে তারা প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করে। লড়তে চাইছেনা সেনারা:- সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে একের পর এক সংগঠিত হামলায় দেশটির অভ্যন্তরে উত্তেজনা বেড়েছে।গত নভেম্বর মাসে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের প্রেসিডেন্ট সতর্ক করে বলেছিলেন,দেশটির শান রাজ্যে শুরু হওয়া যুদ্ধ সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে পুরো দেশই ভেঙ্গে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হবে। ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের বিদ্রোহীদের উত্তর শান রাজ্যের বিশাল এলাকা দখলের কথা উল্লেখ করে একথা বলেন তিনি। উল্লেখ্য,জোটের তিনটি জাতিগত সশস্ত্র বাহিনী এখন চীনের সাথে সীমান্তের বেশির ভাগ অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে।এদিকে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি সম্প্রতি মিয়ানমারের চিন রাজ্যের পালেতোয়া অঞ্চলটি দখল করে নিয়েছে। বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে মাত্র ১৮ কিলোমিটারের মতো দূরত্বে এই এলাকাটি বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশের সীমান্তের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।অন্যদিকে শত শত সৈন্য সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার রাস্তা বেছে নিয়েছে।যুদ্ধ না করেই হাজার হাজার সৈন্য আত্মসমর্পণ করেছে। সব শেষ এই সপ্তাহেও নতুন করে ২৭৮ জন মিয়ানমারের সেনা ভারতের মিজোরামে পালিয়ে গেছেন।নভেম্বর থেকে দফায় দফায় প্রায় ৬০০ জন সেনা সদস্য এভাবেই মিজোরামে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের অনেককে আবার ফেরতও পাঠানো হয়েছে। এর আগে শান রাজ্যে পরাজিত ছয় জেনারেলকে তাদের অপহরণকারীদের সাথে পানীয় পান করতে দেখা যায়।সেখানে তাদের মধ্যে অপমানবোধের চেয়ে স্বস্তিই বেশি দেখা যাচ্ছিলো। তবে সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করার পরে তাদের মধ্যে তিনজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং তিনজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়।অন্যদের হাল ছেড়ে দেওয়া থেকে বিরত রাখতেই এটা করা হয়েছিলো বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভিযানের ৭৫ বছরের দীর্ঘ ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা নজিরবিহীন।সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়েছে। এই অবস্থায় নতুন সদস্য সংগ্রহের কাজটি বেশ কঠিন।আর সেনাদের মনোবলও দিনদিন ভঙ্গুর অবস্থায় চলে যাচ্ছে।সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এখন এটাই মনে করছেন বিশ্লেষকগণ,মিয়ানমারে জান্তার পরাজয়ই হলো অনিবার্য পরিণতি।
(বিবিসির অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও এএফপির রিপোর্টের সমন্বয়ে এই প্রতিবেদন তৈরী করা হয়েছে)