লেখাপড়া না শিখলে নিজের ক্ষতি, জাতির ক্ষতি, এমনকি দেশের ক্ষতি। লেখাপড়া শিখলে সবকিছুর উন্নতি ঘটবে। এগিয়ে যাবে দেশ। আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত রোটারী ডিস্ট্রিক্ট লিটারেসি সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন একুশে পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তিত্ব ও দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক।
গতকাল নগরীর প্রেস ক্লাবের বঙ্গবন্ধু হলে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে রোটারী ক্লাব অব চিটাগাং আপটাউন। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন জেলা গভর্নর প্রকৌশলী মোহাম্মদ মতিউর রহমান, পারসন অব দ্যা সেমিনার ছিলেন পিডিজি এম আবদুল আহাদ, প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন রোটারিয়ান পিপি প্রফেসর ডা. ইমরান বিন ইউনুস, আলোচক ছিলেন প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. মোহীত উল আলম ও রোটারিয়ান পিপি প্রফেসর ডা. ওয়াজির আহমেদ এবং ইভেন্ট চেয়ার ছিলেন রোটারী ক্লাব অব চিটাগং আপটাউনের চার্টার্ড প্রেসিডেন্ট রোটারিয়ান মুবিনুল হক মুবিন। অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন পিডিএফএল পিপি সামিনা ইসলাম, ডিস্ট্রিক্ট সেক্রেটারি মোহাম্মদ আকবর হোসেন, সাবেক ডিস্ট্রিক্ট সেক্রেটারি মোহাম্মদ শাহজাহান, কনফারেন্স চেয়ার মোস্তফা আশরাফুল ইসলাম আলভী, চিফ সার্জেন্ট এট আর্মস নজরুল ইসলাম নান্টু ও ডিআরআর শরিফুল ইসলাম অপু।
আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক তাঁর বক্তব্যে বলেন, সাক্ষরতা মানুষের জীবনঘনিষ্ঠ একটি বিষয়। শুধু জীবনঘনিষ্ঠ নয়, অতি ঘনিষ্ঠ, মানুষের বুলির মতোই প্রায়। নিজেকে প্রকাশ করার অন্যতম অবলম্বন। কিন্তু বর্তমানে শুধু নিরক্ষরতাকে জয় করে মৌলিক সাক্ষরতা অর্জনের মধ্য দিয়ে মানুষের নিত্যদিনের চাহিদা মেটানো ও প্রয়োজনীয় যোগাযোগ সম্পন্ন করা দুরূহ হয়ে পড়ছে। প্রযুক্তি এখন প্রকৃতির মতোই মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজকর্মে আলোকপাত করে। প্রযুক্তিকে বাদ দিয়ে দৈনন্দিন স্বাভাবিক কাজকর্ম সম্পাদন অসম্ভব প্রায়। প্রযুক্তি ব্যবহার যথাযথভাবে রপ্ত করার জন্য দরকার ডিজিটাল সাক্ষরতা।
এম এ মালেক বলেন, ১৯৪০–এর দশকে পড়া ও লেখার দক্ষতাকে সাক্ষরতা বলে অভিহিত করা হয়। ধীরে ধীরে এটা পরিবর্তিত হতে থাকে। ষাটের দশকে পড়া ও লেখার দক্ষতার সঙ্গে সঙ্গে সহজ হিসাবনিকাশের যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষই সাক্ষর মানুষ হিসেবে পরিগণিত হয়। সত্তরের দশকে পড়ালেখা ও হিসাবনিকাশের পাশাপাশি সচেতনতার দক্ষতা এবং আশির দশকে পড়া, লেখা, হিসাবনিকাশ, সচেতনতা ও দৃশ্যমান বস্তু সামগ্রী পঠনের ক্ষমতা সাক্ষরতা দক্ষতা হিসেবে স্বীকৃত হয়। নব্বইয়ের দশকে এসে সাক্ষরতা ভিন্ন রূপ লাভ করে এবং সম্প্রসারিত অবয়বে দক্ষতার ক্ষেত্রে সংযোজিত হয় জীবনের নতুন নতুন চাহিদা। যেমন সামাজিক কর্মকাণ্ডের দক্ষতা, যোগাযোগের দক্ষতা, ক্ষমতায়নের দক্ষতা, জীবন নির্বাহী দক্ষতা, আত্ম প্রতিরক্ষায় দক্ষতা, সাংগঠনিক দক্ষতা ও সাংস্কৃতিক দক্ষতা অর্জনের মূলে রয়েছে সাক্ষরতার মৌলিক দক্ষতা।
তিনি বলেন, রিডিং, রাইটিং ও অ্যারেথমেটিক এই তিন মৌলিক দক্ষতাকে সম্মিলিতভাবে ৩ আরএস বলা হয়। মূল ধারণাটি এসেছে জার্মান ভাষা থেকে। একজন সাক্ষর ব্যক্তি মাতৃভাষায় সহজে লিখতে, পড়তে ও বুঝতে পারেন। মনের ভাব লিখে প্রকাশ করতে পারেন, বুলির মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারেন এবং দৈনন্দিন হিসাবনিকাশ করতে পারেন, প্রয়োজনে লিখে রাখতে পারেন। ১৯৮৯ সালে সাক্ষরতার যে সংজ্ঞা নিরূপণ করা হয়েছিল সেখানে বলা হয়েছিল যে, মাতৃভাষায় কথা শুনে বুঝতে পারা, মৌখিক ও লিখিতভাবে তা প্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় দৈনন্দিন হিসাব করা ও লিখে রাখার ক্ষমতাই সাক্ষরতা দক্ষতা। ৩ অর্জনের মাধ্যমে সাক্ষরতার মৌলিক দক্ষতাগুলো অর্জন সম্ভবপর হয়। ১৯৪৮ সালে ঘোষিত জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণার ধারা ২৬–এ সাক্ষরতা অধিকারের কথা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। এই ঘোষণায় বলা হয়, শিক্ষা প্রতিটি মানুষের একটি মৌলিক অধিকার। মৌলিক স্তর পর্যন্ত সম্পূর্ণ বিনামূল্যে এই শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া কারিগরি ও পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগও বিস্তৃত হতে হবে।
তিনি আরো বলেন, পরিবর্তনশীল বিশ্বে টেকসই ও শান্তিপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণে সাক্ষরতা এখন বড় ভূমিকা পালন করছে। বলা বাহুল্য, শিক্ষা মানুষের জীবনধারায়, সামগ্রিক কার্যপ্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, জীবনযুদ্ধের একটি হাতিয়ার, জীবনমান উন্নয়নের মৌলিক অনুষঙ্গ। এমনকি জীবনের সার্বিক অগ্রগতির নির্দেশক আর সাক্ষরতা শিক্ষার প্রাথমিক সোপান। প্রাতিষ্ঠানিক বা অপ্রাতিষ্ঠানিক, আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক বা উপানুষ্ঠানিক যে কোনো শিক্ষা গ্রহণের প্রস্তুতি হিসেবে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে অবশ্যই সাক্ষরতা জ্ঞান অর্জন করতে হয়। তাই শিক্ষার আবশ্যিক শর্ত সাক্ষরতা অর্জনে জাতিসংঘ এবং ইউনেস্কোর বিশেষ অনুপ্রেরণায় উদযাপিত হয় আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস। এই অনুপ্রেরণা শুরু হয় অনেক আগে, ১৯৬১ সালের ডিসেম্বর মাসে, জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে পৃথিবী থেকে নিরক্ষরতা দূর করার জন্য গৃহীত একটি প্রস্তাব থেকে। এই প্রস্তাবে গরীব দেশের জনসাধারণকে সাক্ষর করার আন্দোলন এবং প্রচার অভিযান চালানোর ওপর জোর দেওয়া হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইতালির রোমে নিরক্ষরতা সমস্যা নিয়ে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনেও নিরক্ষরতা দূর করার নিমিত্তে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়।
আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক বলেন, পরবর্তীকালে ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ৮–১৯ তারিখ পর্যন্ত জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেস্কোর উদ্যোগে ইরানে ১২ দিনব্যাপী একটি বিশ্ব সাক্ষরতা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে পৃথিবীর ৮৮টি দেশের শিক্ষামন্ত্রী ও অনেক শিক্ষা বিশেষজ্ঞ অংশগ্রহণ করেন। এই সম্মেলনেই প্রতি বছরের ৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২০০৭ সালে এসে পড়া, লেখা এবং হিসাবনিকাশের দক্ষতায় গড়ে ওঠা সাক্ষরতার দক্ষতা ও পরিধি আরও সম্প্রসারিত হয়েছে। যার নাম অধিকার সচেতনতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং অভিযোজন ক্ষমতা। এখন ডিজিটাল সাক্ষরতা অর্জনই সাক্ষরতা দক্ষতার অন্য নাম। টেকসই ও শান্তিপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণে সাক্ষরতার ভূমিকা তাই অনস্বীকার্য বলেও বক্তব্যে উল্লেখ করেন এম এ মালেক।