১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে সমাগত মিছিলকারীদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রায় বিরামহীনভাবে ভাষণ দেন। তিনি বলেন, আর আলোচনা নয়, এবার ঘোষণা চাই। তিনি বলেন, আগামীকালের মধ্যে সমস্যার সমাধান না হলে বাঙালিরা নিজেদের পথ বেছে নেবে। আমরা সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ ঐক্যবদ্ধ। কোনো ষড়যন্ত্রই আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না। সরকারের প্রতি তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, বাংলার জনগণের ওপর কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হলে তা বরদাস্ত করা হবে না।
এদিকে রংপুর হাসপাতালের সামনে ক্রুদ্ধ জনতা ও সেনাবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানি সেনারা রংপুর সেনানিবাস সংলগ্ন এলাকায় নিরস্ত্র অধিবাসীদের ওপর বেপরোয়া গুলিবর্ষণ করে। এতে কমপক্ষে ৫০ জন নিহত এবং বহু আহত হন। চট্টগ্রামে পাকিস্তানি সেনারা নৌবন্দরের ১৭ নম্বর জেটিতে নোঙর করা এমভি সোয়াত জাহাজ থেকে সমরাস্ত্র খালাস করতে গেলে হাজার হাজার বাঙালি তাদের ঘিরে ফেলে। সেনাবাহিনীর সদস্যরা জাহাজ থেকে কিছু অস্ত্র নিজেরাই খালাস করে ১২টি ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়ার সময় জনতা পথ রোধ করে। এ সময় পাকিস্তানি সেনারা ব্যারিকেড রচনাকারী জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়।
মিরপুরে অবাঙালিরা সাদা পোশাকধারী পাকিস্তানি সেনা সদস্যদের সহযোগিতায় বাঙালিদের বাড়িঘরের শীর্ষে ওড়ানো বাংলাদেশের পতাকা এবং কালো পতাকা নামিয়ে জোর করে তাতে আগুন দেয় এবং পাকিস্তানি পতাকা তোলে। রাতে বিহারিরা ব্যাপক বোমাবাজি করে আতঙ্কের সৃষ্টি করে।
সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট ভবনে আওয়ামী লীগ ও সরকারের মধ্যে উপদেষ্টা পর্যায়ে বৈঠক হয়। এতে আওয়ামী লীগের পক্ষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও ড. কামাল হোসেন উপস্থিত ছিলেন।
দুই ঘণ্টা স্থায়ী বৈঠক শেষে তাজউদ্দীন আহমদ উপস্থিত সাংবাদিকদের জানান, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বক্তব্য দেওয়া শেষ হয়েছে। এখন প্রেসিডেন্টের উচিত তার ঘোষণা দেওয়া। তিনি বলেন, আজ প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের স্পষ্ট করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, আলোচনা অনির্দিষ্টকাল চলতে পারে না। আওয়ামী লীগ আলোচনা আর দীর্ঘায়িত করতে প্রস্তুত নয়।
এদিন টিভি কেন্দ্রে প্রহরারত সৈন্যরা টিভি কর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করলে সন্ধ্যা থেকে ঢাকা টিভির কর্মীরা সব ধরনের অনুষ্ঠান প্রচার থেকে বিরত থাকেন।
স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দ এক বিবৃতিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে সশস্ত্র গণবিপ্লবকে আরও জোরদার করার জন্য বাংলার জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। সাংবাদিকরা এক জরুরি সভায় মিলিত হয়ে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে সেনাবাহিনীর সদস্যদের হয়রানিমূলক আচরণের তীব্র নিন্দা জানান।
এদিন পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের সদর দপ্তর যশোরে বাঙালি অফিসাররা সর্বপ্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা উত্তোলন করেন। রাইফেলসের জওয়ানরা ‘জয় বাংলা-বাংলার জয়’ গান গাইতে গাইতে ফ্ল্যাগস্ট্যান্ডে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন এবং তারা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকার প্রতি পূর্ণ সামরিক কায়দায় গার্ড অব অনার জানিয়ে ফ্ল্যাগ স্যালুট করেন। ভোলা ও বগুড়ায়ও রাইফেলসের জওয়ানরা নিজ নিজ ছাউনিতে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।
দেশের বিভিন্ন স্থানে রাইফেলস ব্যাটালিয়নে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের খবর দ্রুত পৌঁছে যায় সামরিক জান্তা জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে। নরঘাতক ইয়াহিয়া প্রতিশোধের আগুনে জ্বলে-পুড়ে ছারখার হয়ে গোপনে দেশের প্রতিটি সামরিক ছাউনিতে নির্দেশ পাঠায় যে, আর সময় দেওয়া যাবে না। সুযোগ বুঝে বাঙালি নিধন কর্মসূচি ‘অপারেশন সার্চলাইট’ বাস্তবায়ন শুরু করতে হবে। ক্রুদ্ধ ইয়াহিয়া-টিক্কারা গোপন বৈঠক করে প্রতিটি ক্যান্টনমেন্টেও অপারেশন শুরু করার নির্দেশ জারি করে।
গোপনে তারা যোগাযোগ রক্ষা করতে থাকে স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের নেতা গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, খান এ সবুর খান, মাওলানা ইউসুফ, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, কামারুজ্জামানদের সঙ্গে।
এরই মধ্যে স্বাধীনতাবিরোধী এ চক্রটি রাজাকার-আলবদর বাহিনী গঠনের প্রস্তুতি গ্রহণের পাশাপাশি দেশজুড়ে প্রচারণা চালাতে থাকে যে, ভারতীয় হিন্দুবাদীরা ষড়যন্ত্র করে মুসলমানদের ঐক্য বিনষ্ট করতেই পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দুশমনি শুরু করেছে। আর আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিব ওই ষড়যন্ত্রের হোতা হিসাবে দেশবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত হয়েছে।