ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের ঝড়ো হাওয়া, বৃষ্টিপাত ও জোয়ারের পানিতে চট্টগ্রামে আমন ধান ও শীত ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। জেলার সাতকানিয়া, হাটহাজারী, বাঁশখালী, সীতাকুণ্ড, আনোয়ারা,পটিয়া, চন্দনাইশ, রাঙ্গুনিয়া, রাউজানসহ ১৫ উপজেলার রোপা আমন ধান হেলে পড়েছে। বৃষ্টির ঝাপটায় ও প্লাবনে তলিয়ে গেছে অনেক এলাকার শীতকালীন ফসলের মাঠ। এমন অবস্থায় সমুহ ক্ষতির মুখে পড়েছেন জেলার হাজার হাজার কৃষক।
আবার শীত ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এবার শীতকালীন সবজির সংকট সৃষ্টির পাশাপাশি দামও বৃদ্ধি পাওয়ারও শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
শীতের সময় জমিতে সাধারণত ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, লালশাক, পালংশাক, মুলা, শালগম, শিম, টমেটো, পেঁয়াজ পাতা, লাউ, ব্রোকলি, মটরশুঁটি, গাজর, ধনিয়াপাতা ইত্যাদির চাষ হয়।
চট্টগ্রাম জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এই মৌসুমে জেলার ১৫টি উপজেলায় এ বছর প্রায় ১ লাখ ৭৯ হাজার ৬৩৮ হেক্টর জমিতে আমন চাষ করা হয়েছে। ভারি বর্ষণ ও দমকা হওয়ায় জেলার ১৫টি উপজেলায় প্রায় ১ হাজার ৪৮২ হেক্টর জমির আমন ফসল তলিয়ে গেছে। একই সঙ্গে জেলার প্রায় ৮ হাজার ১৫১ হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজি আবাদ করা হয়। তবে ঝড়ো হাওয়া ও বৃষ্টির কারণে জেলার প্রায় ৩৬৪ হেক্টর জমির শীতকালীন সবজি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সিত্রাং নিস্তেজ হওয়ার পর কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে ক্ষয়ক্ষতির তথ্য ও হিসাব নির্ণয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু হয়েছে।
এই ব্যাপারে চট্টগ্রাম জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিপ্তরের উপ-পরিচালক মো. আক্তারুজ্জামান স্লোগান নিউজকে বলেন, এবার বিলম্বিত বৃষ্টি হয়েছে। আবার এরমধ্যে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের আগমন। সিত্রাংয়ের প্রভাবে আপাত দৃষ্টিতে চট্টগ্রামে তুলনামুলক কম ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আমন ধান ও ফসলের যা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা মোটামুটি সামান্য তবে তা ক্ষতিই বটে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানতে ইতিমধ্যে উপজেলা ভিত্তিক তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এই সপ্তাহের মধ্যে পুরো জেলার প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির তথ্য প্রতিবেদন প্রস্তুত করা যাবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী গত দুইদিনে বাঁশখালী, আনোয়ারা, বোয়ালখালী,সীতাকুন্ড উপজেলার ক্ষয়ক্ষতির চিত্র সংগ্রহ করা হয়েছে । বাঁশখালী উপজেলায় আমন ফসলের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। জেলার বাঁশখালীতে মোট ১ হাজার ৪৮২ হেক্টর জমির আমনের মধ্যে ৮০০ হেক্টর জমিতে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ।
বাঁশখালী উপজেলার চাষী আলী হোসেন জানান, সিত্রাংয়ের সময় অমাবস্যার ভরা কটালের জোয়ার থাকায় অতিরিক্ত পানি উঠেছে। আমাদের এখানে প্রায় ৬/৭ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস সৃষ্টি হয়েছে। ১৯৯১ সালের ২৯শে এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়ের পর এত পানি আর আমরা দেখিনি । লবণাক্ত পানিতে জমির ধান একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। শুধু ধান নয় লবণাক্ত পানির কারণে জমির উর্বরতাও নষ্ট হয়েছে। আবার তার সাথে বৃষ্টি আর বাতাসের দাপট।
উপকূলীয় উপজেলা সীতাকুন্ডে ১২শ হেক্টর জমির ফসলের মধ্যে ৬০০ হেক্টর জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সিত্রাংয়ের ঝড়ো বাতাস ও বৃষ্টির কারণে সীতাকুন্ডে শীতকালীন বিভিন্ন সবজির ক্ষেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সীতাকুন্ডের স্থানীয় কৃষক জমির মওলা জানান, সীতাকুন্ডে বেশির ভাগ চাষাবাদ হয় পাহাড় এলাকা ও পাহাড়ের পাদদেশ এলাকায়। এখানে সমুদ্রের পানির চেয়ে বেশি ক্ষতিকারক হয়ে উঠেছে ঝড়ো বাতাস আর বৃষ্টি। বাতাসের তোড়ে শিম, পটল, ঝিঙা, চিচিঙ্গা,বরবটিসহ মাচাঙে চাষ করা সবজির সমুহ ক্ষতি হয়েছে। ক্ষেতের মাচাঙগুলো একেবারে তছনছ হয়ে গেছে। ফলে সবজির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বেশি। আমরা এখন বলতে গেলে দিনরাত পরিশ্রম করে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষেত সারিয়ে তুলছি।
এদিকে, আনোয়ারা, চন্দনাইশের শঙ্খ নদীর উপকূলীয় এলাকায় প্রায় ২৫০ হেক্টর জমির সবজি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বোয়ালখালীতে ২৫ হেক্টর জমির সবজি ক্ষতিকগ্রস্ত হয়েছে।
চন্দনাইশ উপজেলার দিয়াকুল তপোবন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুধীর মল্লিক জানান, বৃষ্টির কারণে এলাকার আলু, ফুলকপি, বাঁধাকপির ক্ষেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেশি। ক্ষেতের মধ্যে বৃষ্টির পানি জমে থাকায় আলু ,মুলা, পেঁয়াজ বা গাজরের মত মাটির নিচে জন্মানো সবজিগুলো পচে যাবার শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই এখন ক্ষেতের পানি নামানোর কাজ করছেন। আবার যারা ক্ষেতে আগাম সবজি আবাদ করেছিলেন তাদের অনেকেই পঁচে যাবার ভয়ে অপ্রাপ্ত হলেও আলু, মুলা গাজর তুলে নিচ্ছেন। কারণ পানি লাগলে এসব সবজি শুধু পচে যায় তাই নয় এগুলোকে পিঁপড়াসহ নানাজাতের কীটপতঙ্গ আক্রমণ করবে।
এদিকে, সিত্রাংয়ের কারণে পালংশাক, লালশাক, মুলাশাক, কপিশাকসহ নানা জাতের শাক ও ধনিয়া পাতা ক্ষেতের সমুহ ক্ষতি হয়েছে বলে জানা গেছে।