বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ ঘোষিত দেশের কার্পজাতীয় মাছের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র ও মৎস্য অভয়ারণ্য হালদা নদীর পাড় ঘেঁষে পুনরায় গড়ে উঠেছে জৈববৈচিত্র্য বিধ্বংসী ইট ভাটা। নেই সংশ্লিষ্ট দপ্তরসমুহের কার্যকারী পদক্ষেপ। এতে অকার্যকর হয়ে পড়েছে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজের শর্তাবলী।
সরেজমিনে দেখা যায়, রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়া ইউনিয়নের মোকামিপাড়া গ্রামের হালদা নদীর পূর্বপাড় ঘেঁষে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এ. আলী ইট ভাটার পাকা চিমনি। চিমনির উত্তরে হালদার পাড় কেটে এবং হালদা নদীতে চলাচলে নিষিদ্ধ ইঞ্জিন চালিত নৌকা ও ড্রেজারে করে মাটি এনে মজুদ করা হয়েছে। সার্বিকভাবে দেখা যায়, ইট তৈরির জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত রয়েছে এ. আলী ইট ভাটার মালিক পক্ষ।
গত ২০২১ সালের ১০ মার্চ চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক কার্যালয়, রাউজান উপজেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর সমন্বিত অভিযান পরিচালনা করে হালদার পাড়ে অবৈধ ইটা ভাটা স্থাপন, হালদা নদীর জৈববৈচিত্র্য ধ্বংস ও পরিবেশের ছাড়পত্র না থাকার দায়ে এই ইট ভাটাটি উচ্ছেদ করা হয়েছিল। উচ্ছেদের সপ্তাহখানেক মধ্যে প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে পুনরায় পরিবেশ দূষণকারী ড্রাম চিমনি তৈরি করে কাঠ দ্বারা ইট পুড়িয়েছেন মালিক পক্ষ। এখন একই স্থানে নতুন করে তৈরি করা হয়েছে পাকা চিমনি। ইট ভাটা নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৩ এর ৮ ধারা, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন এর ৫ ধারা তোয়াক্কা না করে মালিক পক্ষ পুনরায় গড়ে তুলেছেন এই ইট ভাটা।
ইট ভাটা স্থলে মালিক পক্ষের উপস্থিতি না থাকায় এবং মুঠোফোনে সংযোগ না পাওয়ায় এই বিষয়ে মালিক পক্ষের কারো বক্তব্য পাওয়া যায় নি।
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. ফেরদৌস আনোয়ার বলেন যেটা ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে এ. আলী, তাদের বিষয়ে কোন আবেদন আমরা পায় নি। জানি না তারা কিভাবে করছে। এই বিষয়ে না জেনে বলা যাচ্ছে না। তবে নিষিদ্ধ স্থানে ইট ভাটা স্থাপন করা যাবে না। আর আবেদন করলেও আইন-আইন বিধির বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।
এছাড়া গত ২০২০ সালের ২২ ডিসেম্বর মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে এই হালদা নদীকে ‘বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ’ ঘোষণা করেন। এটি বাস্তবায়নে ১২ টি শর্তের মধ্যে ২,৩ ও ৪ নম্বর শর্তে উল্লেখ রয়েছে প্রাণী ও উদ্ভিদের আবাসস্থল ধ্বংসকারী কোনও প্রকার কার্যকলাপ করা যাবে না। ভূমি ও পানির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট/ পরিবর্তন করতে পারে, এমন সব কাজ করা যাবে না। মৎস্য ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর কোনও প্রকার কার্যাবলী করা যাবেনা। হালদার পাড়ে ইট ভাটা স্থাপনের কারণে বর্তমানে এসব শর্তাবলীকে অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।
হালদা গবেষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মনজুরুল কিবরিয়া বলেন, হালদার পাড় ঘেঁষে শুধু ইট ভাটা নয় যে কোন শিল্প কারখানা স্থাপনের ফলে নদীর জৈববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজের একাধিক শর্ত ভঙ্গ হচ্ছে। মাছের প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। বিশেষ করে মা মাছ ও ডলফিনের উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। নদীর পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।
দীর্ঘ ৩০ বছরের অধিক সময় ধরে এই ইট ভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ায় হালদা পারের বাসিন্দারা নানান রোগ-শোকে ভুগছেন। ব্যাঘাত ঘটেছে ফসল উৎপাদনেও।
এই ইট ভাটা সংলগ্ন হালদা পাড়ের বাসিন্দা সাংবাদিক এস.এম. ইউসুফ উদ্দিন বলেন, এই ভাটাগুলোর কারণে মোকামী পাড়া গ্রামের বেশীরভাগ বয়স্ক নারী পুরুষরা শ্বাস কষ্ট রোগে ভুগছেন। ইটভাটার ধোঁয়ায় এ রোগের পাশাপাশি চর্ম এবং এলার্জি রোগেও এই এলাকার সব বয়সী মানুষ ভোগেন বছরে ছয় মাস। গ্রামের ধানি জমিতে ফসলের ফলনে ধস নেমেছে। শাক শবজির চাষ হলেও ফলন হয় রুগ্ন। একারণে এই এলাকার কৃষকেরা দুশ্চিন্তাই আছেন।
রাউজান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুস সামাদ সিকদার বলেন, এই বিষয়ে আমরা খতিয়ে দেখব। হালদার দূষণ হয় বা হালদার জৈববৈচিত্র্য জন্য হুমকি এমন কিছু আমরা রাখবো না।
ইমা