চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশী পাট ও পাটপণ্যের রপ্তানি কমে যাচ্ছে

 উজ্জ্বল দত্ত |  বুধবার, অক্টোবর ১২, ২০২২ |  ৮:০৫ অপরাহ্ণ
       

বিশ্ব বাজারে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশী পাট ও পাট পণ্যের রপ্তানি দিন দিন কমে যাচ্ছে। গত কয়েক বছরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানির পরিমাণ অর্ধেকে নেমে গেছে। এই বন্দর দিয়ে ২০১৭ সালে ৯ লাখ ২৯ হাজার ২৮০ টন পাট ও পাট পণ্যের রপ্তানির রেকর্ড রয়েছে। তবে ২০২১ সালে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৫ লাখ ৮৪ হাজার ৩৭৫ টন।

বিকল্প পণ্যের বাজার দখল, পাটকলগুলোতে উৎপাদন কমে যাওয়া, সরকারি মিল বন্ধ হয়ে যাওয়া, শ্রমিক অসন্তোষ, বিশ্ব বাজারে পাটের বাজার সংকুচিত হয়ে পড়া, অন্য দেশের পাট পণ্যের তুলনায় বাংলাদেশী পণ্যের পিছিয়ে পড়া, বাজারজাতকরণে সঠিক পদক্ষেপের অভাব, আমদানিকারক দেশে বাজার বন্ধ হয়ে যাওয়াসহ নানামুখী কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ মহল।

চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ২০১৭ সালে ২ লাখ ৬ হাজার ৪৮০ মেট্রিকটন, ২০১৮ সালে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৮২৮ মেট্রিকটন, ২০১৯ সালে ১ লাখ ৫৪ হাজার ৮৪০ মেট্রিকটন, ২০২০ সালে ১ লাখ ৮৩ হাজার ৪৫ মেট্রিকটন ও ২০২১ লাখ ৩৮ হাজার ২৬৮ মেট্রিকটন কাঁচা পাট রপ্তানি হয়। পাশাপাশি পাট পণ্যের মধ্যে ২০১৭ সালে ৭ লাখ ২২ হাজার ৮শ মেট্রিকটন, ২০১৮ সালে ৫ লাখ ৫১ হাজার ৫১৮ মেট্রিকটন, ২০১৯ সালে ৪ লাখ ৭৬ হাজার ৭০ মেট্রিকটন, ২০২০ সালে ৪ লাখ ৮৯ হাজার ৫১ মেট্রিকটন ও গতবছর ৪ লাখ ৪৬ হাজার ১০৭ মেট্রিকটন পাটপণ্য চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে রপ্তানি হয়।

বিশ্ব বাজারে কেন বাংলাদেশী পাটের বাজার কমে যাচ্ছে সে কারণ অনুসন্ধানে কয়েকটি কারণ জানা গেছে।

কারণ-১: সরকারি মিলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে হেশিয়ান, সেকিং এবং সিবিসি পণ্যের উৎপাদন প্রায় ৩৮ শতাংশ কমে গেছে। এতে করে বাংলাদেশ তার বড় ক্রেতাগুলোর চাহিদা মত পণ্য রপ্তানি করতে পারছে না। আর চাহিদা পূরণ না করতে পারায় ক্রেতাদেশগুলো পাশ^বর্তী দেশ ভারতসহ অন্যান্য দেশের কাছ থেকে পাট ও পাট পণ্য কিনে নিচ্ছে।

কারণ-২: বছরের জুলাই থেকে আগষ্ট মাসে পাটের মৌসুম শুরু হয়। মৌসুমে দেশীয় ব্যক্তি পর্যায়ের পাটকলগুলো কিন্তু সারা বছরের জন্য কাঁচামাল কিনে মজুত করে রাখতে পারে না। কারণ তাদের কাছে কাঁচামাল মজুত করার সামর্থ্য বা সক্ষমতা পর্যাপ্ত নেই। তারা কাঁচা পাট কিনে প্রতি মাসে বা তাদের চাহিদা ও সুবিধা অনুযায়ী।

কারণ-৩: ভরা মৌসুমে তুলনামুলক কম মূল্যে কাঁচামাল কিনে নেয় ফরিয়া ব্যবসায়ীরা। আবার মৌসুমে কম দাম থাকায় ভারতীয় পাটকলগুলোও বাংলাদেশের পাট কিনে সংরক্ষণ করে রাখে।

কারণ-৪: অফ সিজনে পাটের দাম স্বাভাবিক ভাবে বাড়তি থাকে। আবার দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশীয় ছোট পাটকলগুলো বেশি দামের পাট কিনে উৎপাদন খরচের সাথে বাজারমূল্যের ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে না। ফলে কাঁচামাল যোগান না থাকায় তাদের পাটকলগুলোতে উৎপাদন কমে যায়। আর উৎপাদন কমে যাওয়ায় ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য রপ্তানি করা যায় না। আর এমন পরিস্থিতিতে চাহিদা পূরণ করতে না পারায় ক্রেতারা ভারত বা অন্যান্য দেশে তাদের অর্ডার দিয়ে দেয়। এভাবেই বিশ্ব বাজারে প্রতি বছর বাংলাদেশী পাট ও পাটপণ্যের রপ্তানি কমে যাচ্ছে।

জানা গেছে, স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে অস্ট্রেলিয়া, জাপান, সুইডেন, ইরান, সৌদি আরব, সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি বাংলাদেশী পাটপণ্য রপ্তানি হয়ে আসছে। এসব দেশ ছিল বাংলাদেশী পাটপণ্যের উল্লেখযোগ্য ক্রেতা। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে সেসব ক্রেতাদেশগুলোতে বন্ধ হয়ে গেছে বাংলাদেশী পাটের বাজার। তাই পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি দফায় দফায় কমেছে। ১৯৭২ সাল বা তার কাছাকাছি সময়ে পাট ও পাট পণ্য রপ্তানি করে ৩৪ কোটি ডলার আয় করে বাংলাদেশ। আর এখন তা ১৮ কোটি ডলারে নেমে এসেছে।

বর্তমানে সারা দেশে ২২টি পাটকলের মধ্যে সাতটি চট্টগ্রামে অবস্থিত। এসব পাটকলে প্রধানত হেসিয়ান কাপড়, ব্যাগ, বস্তা, সুতা, কম্বল, মোটা কাপড়, সিবিসি পণ্য তৈরি করা হয়। চট্টগ্রামের ৭টি পাটকলের মধ্যে প্রথম ১৯৫৪ সালে ৮০ একর জায়গার উপর প্রতিষ্ঠা করা হয় আমিন জুট মিলস। এই পাটকলে ১৯ হাজার ৬২৭ মেট্রিকটন পণ্য উৎপাদনের ক্ষমতা থাকলেও বর্তমানে কারখানাটিতে ১৪ হাজার ৭১৭ মেট্রিকটন উৎপাদন হচ্ছে। ১৯৬৬ সালে ৫১ একর জায়গার উপর প্রতিষ্ঠিত গুল আহম্মদ জুট মিলস নামের কারখানাটিতে উৎপাদন কমেছে ৪৮৯ মেট্রিকটন। ৫৩ বছরের ব্যবধানে ৬৭ একর জমির উপর গড়ে তোলা হাফিজ জুট মিলে ১ হাজার ৪৮৩ মেট্রিকটন ও এম এম জুট মিলসের উৎপাদন ২৯ মেট্রিকটনে নেমেছে।

এদিকে আর আর জুট মিলে ২ হাজার ৯১৬ মেট্রিকটন পণ্য উৎপাদনের সক্ষমতা থাকলেও বর্তমানে সেখানে উৎপাদন হচ্ছে ১ হাজার ৯৫৮ মেট্রিকটন পণ্য। বাগদাদ-ঢাকা কার্পেট ফ্যাক্টরি লিমিটেডে ধারণ ক্ষমতার ২৭২ মেট্রিকটন কম পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে। তাছাড়া ১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া কেএফডি লিমিটেড জুট মিলে ২ হাজার ২৪৬ মেট্রিকটন পণ্য উৎপাদনের ধারণ¶মতা থাকলেও সেখানে এখন উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ৭২০ মেট্রিকটন পণ্য।

এই ব্যাপারে আমিন জুট মিলস’র বিভাগীয় প্রধান (প্রকল্প প্রধান) এএসএম কামরুল ইসলামের যোগাযোগ করা হলে স্লোগান নিউজকে তিনি বলেন, বাজার ফিরিয়ে আনতে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। সরকারি পাটকলগুলোকে প্রাইভেটাইজেশনের মাধ্যমে গতিশীল করার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। এতে করে বন্ধ থাকা পাটকলগুলো স্বাভাবিক উৎপাদনে ফিরে যাবার একটি সুযোগও সৃষ্টি হবে। গুণগত মান, ডিজাইনের দিক দিয়ে বিশ^ বাজারে আমাদের পাট ও পাট পণ্যের চাহিদা ভিন্ন অবস্থানে রয়েছে।