নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিঃপূনর্গঠন প্রক্রিয়ায় বড় দুই দলের সর্বশেষ হালচাল (২)

নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সদ্য ঘোষিত কমিটিকে কেন্দ্র করে দলে বিভক্তি চরমে,হতাশ তৃণমূল

 রাসেল আদিত্য, নারায়ণগঞ্জ থেকে |  বৃহস্পতিবার, অক্টোবর ৬, ২০২২ |  ৪:৫৫ অপরাহ্ণ
       

বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সীমাহীন প্রত্যাশা নারায়ণগঞ্জকে ঘিরে।অনেকেই দাবী করে থাকেন, গত ১৪ বছরে দেশের সকল জেলাতেই দলের সাংগঠনিক ক্ষমতা কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।কিন্তু নারায়ণগঞ্জ বিএনপি ছিলো ব্যতিক্রম।সকল আন্দোলন সংগ্রামেই নারায়ণগঞ্জের নেতাকর্মীরা সংখ্যায় কম হলেও রাজপথে নামতে সচেষ্ট ছিলেন।যেহেতু রাজধানীতে দল খুব একটা সুবিধা করতে পারছেনা তাই নারায়ণগঞ্জকে ঘিরেই আন্দোলন পরিকল্পনা কষছেন কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ।

সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির কর্মসূচীতে বারবার নারায়ণগঞ্জ শিরোনাম হওয়ায় বিএনপি থিংক ট্যাংক আশাবাদী হয়ে নারায়ণগঞ্জে সংগঠনকে গোছাতে যত্নবান হয়েছেন।সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পরপরই তাঁদের সেই কার্যক্রম শুরু হয়।

ইতিমধ্যে জেলা কমিটি পূর্নগঠন শেষে জেলার সকল থানায় আহবায়ক কমিটি,বিভিন্ন পৌর ও ইউনিয়ন কমিটি গঠনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।সেই ধারাবাহিকতায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত মহানগর কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া চলে কেন্দ্রীয় ভাবে।শেষে গত ১৩ই সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় দফতর সম্পাদক রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত ৪১ সদস্য বিশিষ্ট মহানগর বিএনপির আহবায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়।এডভোকেট সাখাওয়াতকে আহবায়ক ও আবু আল ইউসুফ খাঁন টিপুকে সদস্য সচিব করা হয়। কমিটির যুগ্ম আহবায়ক হিসেবে যথাক্রমে অ্যাডভোকেট জাকির হোসেন, অ্যাডভোকেট সরকার হুমায়ুন কবির, আ. সবুর খান সেন্টু, হাজী নুরুদ্দীন, আতাউর রহমান মুকুল, মনির হোসেন খান, আনোয়ার হোসেন অনু, ফতেহ মো. রেজা রিপন, এম এইচ মামুন, আবুল কাউসার আশাকে রাখা হয়।সদস্য পদে রাখা হয় যথাক্রমে অ্যাডভোকেট রফিক আহম্মদ, হাজী ফারুক হোসেন, আওলাদ হোসেন, শওকত হাসেম শকু, হাসান আহম্মদ, মাহাবুব উল্লাহ তপন, মাসুদ রানা, ডা. মজিবর রহমান, মাকিদ মোস্তাকিন সিপলু, রাশিদা জামাল, এইচ এম আনোয়ার প্রধান, হান্নান সরকার, অ্যাডভোকেট বিল্লাল হোসেন, হাবিবুর রহমান দুলাল, হাবিবুর রহমান মিঠু, মনোয়ার হোসেন শোখন, বরকত উল্লাহ, মো. আলমগীর হোসেন, অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান মোল্লা, শহিদুল ইসলাম রিপন, আমিনুল ইসলাুম মিঠু, ফারুক আহম্মদ রিপন, মাহমুদুর রহমান, অ্যাডভোকেট শরিফুল ইসলাম শিপলু,ওু শাখাওয়াতুল ইসলাম রানা, মোু. ফারুক হোসেন, কামরুল হাসান সাউদ চুন্নু, হুমায়ুন কবির ও শাহিন আহম্মদকে।পরদিন ১৪ তারিখ থেকে শুরু হয় ঘোষিত কমিটি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশের পালা।

নিজের ফেসবুক আইডিতে ঘোষিত কমিটি থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন বন্দর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান,বহুল আলোচিত-সমালোচিত বিএনপি নেতা আলহাজ্ব আতাউর রহমান মুকুল।তারপর একই পন্থায় কমিটি থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন
সদ্যগত সিটি নির্বাচনে কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়া আবুল কাউসার আশা ও আমিনুল ইসলাম মিঠু।তন্মধ্যে মুকুল ও আশাকে রাখা হয়েছিল যুগ্ম আহবায়ক ও মিঠুকে সদস্য পদে।তিনজনই দলের আদর্শ ধারণ করে দলের জন্য কাজ করে যাবেন বলে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।আশা তাঁর পোস্টে কমিটির নেতাদের ঈমানদার বলে কটাক্ষ করলেও সরাসরি কোন কারণ দেখাননি পদত্যাগের।তবে আমিনুল ইসলাম মিঠু দলের নিবেদিত প্রাণ ও যোগ্যদের কমিটিতে স্থান না দেবার জন্য পদত্যাগ করেছেন বলে জানান।

দুই দিন পরেই নবগঠিত ৪১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি থেকে ১৫ নেতা পদত্যাগ করেছেন।গত১৮ সেপ্টেম্বর জেলা ওলামা দলের সভাপতি মুন্সী শামসুর রহমান বেনু ও নিহত যুবদল নেতা শাওনের জন্য দোয়া ও মিলাদ অনুষ্ঠান শেষে পদত্যাগের ঘোষণা দেন নেতারা। পরে পদত্যাগ পত্রও জমা দেন। তার আগে নিজেদের পদত্যাগ পত্র কেন্দ্রে পাঠিয়েছেন তারা।

কেন্দ্র থেকে মহানগর বিএনপির কমিটি গঠনেরপদত্যাগকারী নেতারা হলেন- মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও সর্বশেষ কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সবুর খান সেন্টু, যুগ্ম আহ্বায়ক হাজী নুরুদ্দিন, আতাউর রহমান মুকুল, আবুল কাউসার আশা, সদস্য অ্যাডভোকেট বিল্লাল হোসেন, আলমগীর হোসেন, শহিদুল ইসলাম রিপন, আমিনুল ইসলাম মিঠু, মনোয়ার হোসেন শোখন, ফারুক হোসেন, হাজী ফারুক হোসেন, হান্নান সরকার, আওলাদ হোসেন, অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান মোল্লা, অ্যাডভোকেট শরীফুল ইসলাম শিপলু। এ ছাড়াও কমিটির আরও কয়েকজন নেতা ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলতি কমিটি থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন।

পাঁচ দিনের মাথায় ১৫ জনের পদত্যাগ পরিস্কার বুঝিয়ে দেয় দলটির আন্তঃকোন্দলের গভীরতা। শহরের বিএনপির কয়েকজন দল অন্তঃপ্রান কর্মিরসাথে আলাপ করে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জ সদর – বন্দর তথা ৫ আসনের তিনবারের সাংসদ,সদ্য বাতিল ঘোষিত মহানগর বিএনপির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করা এডভোকেট আবুল কালামের ভাই হলেন মুকুল ও আশা হলেন তাঁর ছেলে।আর মিঠুও কালাম ব্লকের হিসেবেই চিহ্নিত।মহানগর সহ জেলার বিভিন্ন জায়গায় কালাম ব্লকের বিপুলসংখ্যক অনুসারী আছেন তৃনমূলে।মহানগর বিএনপি কমিটি নিয়ে তৃনমূলেও ব্যাপক অসন্তোষ বিরাজমান।বিএনপির বিভিন্ন ইউনিয়ন ও পৌর নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জে আওয়ামীলীগ দুই ভাগে বিভক্ত এটা সারাদেশ জানে।কিন্তু এখানে বিএনপি বহুধা বিভক্ত।সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পর থেকে জেলার কিছু নেতা কেন্দ্রকে নিজেদের কব্জায় নিয়ে শুরু করে নারায়ণগঞ্জে দলকে মুষ্টিমেয় কিছু লোকের মুঠোয় নেবার মিশন।

প্রথমে তাঁরা এডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার, এটিএম কামালের মতো বটবৃক্ষকে উপড়ে ফেলে।একই এজেন্ডা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ঢাকার পুরানা পল্টনের ফুটপাতে ছুরিকাহত হন জেলা বিএনপির সদস্য সচিব অধ্যাপক মামুন মাহমুদ।সেই ঘটনার মাষ্টার মাইন্ড বলে অভিযুক্ত করা হয় বিএনপির আরেক প্রভাবশালী নেতা সাবেক সাংসদ আলহাজ্ব গিয়াসউদ্দিন আহমদের ছেলেকে। সিদ্ধিরগঞ্জের অনেকেই তখন বিস্মিত হয়েছিলেন।কেননা গিয়াসউদ্দিন আহমদের এক ছেলে সারজিল আহমেদ রাজনীতির সাথে যুক্ত।নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত কাউন্সিলরও সারজিল আহমেদ।আরেক ছেলেকে কখনোই রাজনীতির আশেপাশে দেখেনি কেউ।সে পিতার ব্যবসা নিয়েই থাকে।স্থানীয় মানুষ তাঁকে একজন নিরীহ ও শান্ত ছেলে হিসেবেই জানেন

সেই ঘটনার সূত্র ধরে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন গিয়াসউদ্দিন আহমদ।সিদ্ধিরগঞ্জ থানা বিএনপির কয়েকজন নেতার সাথে কথা বলে জানা যায়, মামুন মাহমুদ সিদ্ধিরগন্জ এলাকার লোক।তাঁর পথ পরিস্কার করতে অনেক দিন ধরেই সক্রিয় জেলা বিএনপির একটি অংশ।সিদ্ধিরগঞ্জ বিএনপি মানে গিয়াসউদ্দিনকেই মনে করা হয়ে থাকে। স্থানীয় তৃনমুল পর্যায়ের সকলেই তাঁর অনুসারী।
গিয়াসউদ্দিনের একক বলয় ভাঙতে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা বিএনপির কাউন্সিল করার চেষ্টা করলেও স্থানীয় নেতাকর্মিরা সেই সম্মেলন পন্ড করে দেয়।

ঐ ঘটনার কয়েকদিন পরেই অধ্যাপক মামুন হামলার শিকার হন।সেই সম্মেলনে অতিথি হয়ে আসা কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন।কেন্দ্রের কাছে গিয়াসউদ্দিন আহমদকে খলনায়ক প্রমান করতে সম্মেলন পন্ডকারী ও মামুনের উপর হামলাকারীরা একই গ্রুপ তথা গিয়াস গ্রুপের লোক হিসেবে চিন্হিত করা হয়। গত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পর পরই জেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত আহবায়ক মনিরুল ইসলাম রবি ও সদস্য সচিব অধ্যাপক মামুন মাহমুদ একের পর এক ইউনিয়ন,থানা ও পৌর বিএনপির আহবায়ক কমিটি গঠন করেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে,প্রায় সবগুলো কমিটিতে নিজেদের অনুগতদের প্রাধান্য দিয়ে কমিটি করেছেন।নারায়ণগঞ্জ শহরের আলোচিত এক বিএনপি নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই প্রতিবেদককে বলেন,আসলে যাকিছু হম্বিতম্বি আপনারা ইতিপূর্বে দেখেছেন তার সবই ছিলো আইওয়াশ।নারায়ণগঞ্জ বিএনপি এখন পেঁপেঁ গাছ মাত্র।তৈমুর আলম খন্দকার, কামালদের ছাড়া নারায়ণগঞ্জ বিএনপি খালি কলস।জেলায় যাঁরা নেতৃত্বে আছেন,সাংবাদিকেরা খোঁজ নিয়ে দেখুন তাঁরা আওয়ামীলীগের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে চলেছে।সেই দিন বেশি দূরে নয়, যেদিন এঁদের মুখোশ উন্মোচিত হয়ে যাবে।

এদিকে পদত্যাগী ১৫ জনকে বিভিন্ন মাধ্যমে কমিটিতে ফিরতে বলা হলেও তাঁরা নিজেদের সিদ্ধান্তে অনড় থেকে পাল্টা ঘোষণা দেন, পদ বিহীন থেকে শহিদ জিয়ার সৈনিক হিসেবে তাঁরা সকল কর্মসূচী পালন করে যাবেন।মুকুল বলেন,বিএনপির কর্মী হয়েই আমরা রাজপথ কাঁপাবো।

এই দ্বন্দ্বের শেকড় অনেক গভীরে।কয়েক বছর আগে যাঁদের মাঝে দা কুড়াল সম্পর্ক ছিলো, আজ তাঁরা কমিটির মূল নেতৃত্বে।মহানগর বিএনপির অনেক নেতার বিরুদ্ধেই ওসমান পরিবারের সাথে আতাঁতের অভিযোগ রয়েছে।২০১৬ এর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী এডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন ওসমান পরিবারের কাছ থেকে দুই কোটি টাকা নিয়েছেন বলে প্রকাশ্যে অভিযোগ করেছিলেন,সেই ভোটে সাখাওয়াতের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ হয়ে থাকা আবু আল ইউসুফ খাঁন টিপু।এখন তাঁরা একজোট হয়েছেন।নারায়ণগঞ্জ শহর বিএনপির রাজনীতি গত দুই দশক ধরে পর্যবেক্ষণ করে আসা একটি আন্তর্জাতিক সেবা সংস্থার হয়ে শহরে কর্মরত, রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক এন এইচ জামিল এই প্রতিবেদককে বলেন,রাজনীতি করতে আপনার লোকবল লাগবে।নারায়ণগঞ্জে বিএনপি বহু আগে থেকেই বহুধা বিভক্ত।যদি মহানগর বিএনপির আহবায়ক কমিটি নিয়ে বলতে হয়,তাহলে এককথায় একটা পক্ষপাতদুষ্ট কমিটি দেওয়া হয়েছে।যাঁরা বেরিয়ে গেছে তাঁদের নিজস্ব লোকবল আছে।এখন অবশিষ্ট কমিটি পারবেনা শহরে কোন একটা মিটিং করতে।কেননা তাঁদের লোকবল নেই।তিনি আরও বলেন,গত সিটি ইলেকশনের পর হইতে আমি জেলা ও কেন্দ্রীয় কমিটির একের পর এক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত দেখে রীতিমতো স্তম্ভিত হয়ে গেছি।সাকাচৌর ভাষায় বলতে ইচ্ছে করছে,নারায়ণগঞ্জ বিএনপি নিয়ে লেজটা আসলে কুকুর নাড়ায় না লেজই কুকুর নাড়াচ্ছে?কথা হয় বিএনপির প্রবিণ নেতা হাজী মোক্তার চৌধুরীর সঙ্গে।তিনি চরম বিরক্তি প্রকাশ করে বলেন “যারে দিয়া তুমি রামের মা,এহন তাঁরেই তুমি চিনোনা”? নারায়ণগঞ্জের মানুষ বিএনপি বলতে যাঁদের চিনে তাঁদের দল থেকে বাইর কইরা দেওয়া হইছে।এঁদের নিয়া কথা বলতে ইচ্ছা করেনা।

প্রকৃত অর্থে মহানগর কমিটি ঘোষণার পরে পুরো জেলার সাংগঠনিক চিত্র ফুটে উঠেছে বিএনপির।দফায় দফায় কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের মাধ্যমে পদত্যাগী নেতৃবৃন্দকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, এমনকি তারেক জিয়ার আহবানও ব্যর্থ হয়েছে।

এককথায় বললে বলতে হয়,এডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকার,এটিএম কামাল,গিয়াসউদ্দিনদের
বহিষ্কার ও কৌশলে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়ার মাধ্যমেই পথ হারিয়েছে স্থানীয় বিএনপি।

ইমা