আজ থেকে ১৫ বছর আগে ২০০৭ সালের ৯ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ১২টায় মক্কার জিয়াদ হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন আলহাজ্ব মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী। চট্টগ্রামের আধুনিক সংবাদপত্রের পথিকৃৎ চট্টলদরদী বহুমাত্রিক গুণের অধিকারী এই দেশবরণ্য ব্যক্তি দৈনিক পূর্বকোণের প্রতিষ্ঠাতা। মৃত্যুর ৩ দিন পর ফজরের নামায শেষে মসজিদুল হারামে মরহুমের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর সকাল ৯টায় মক্কার সবায়ে মকবায় তাঁকে দাফন করা হয়। তিনি পবিত্র ওমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে ওই বছর ৭ সেপ্টেম্বর মক্কা গিয়েছিলেন।
১৯২১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর রাউজানের ঢেউয়া হাজিপাড়া এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিসরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাংলাদেশের ডেইরি ও পোল্টি শিল্পের অন্যতম দিকপাল। তিনি এ সংগঠনের সভাপতিও ছিলেন। একাধারে তিনি ছিলেন নজরুল গবেষক। নজরুল মেলা ও নজরুল পাঠাগার স্থাপন করেন। বিআইটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নিতকরণ ও চট্টগ্রামে ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সহ অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সাথে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত জড়িত ছিলেন তিনি। এসময় একজন সত্যিকারের দেশদরদী হিসেবে সাধারণের কাছে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বেঁচে থাকার তাগিদে মানুষকে নানা চড়াই উৎরাই পাড় হয়ে জীবন যুদ্ধে টিকে থাকতে হয় তেমনি একজন নিবেদিত প্রাণ মানুষ হচ্ছেন দৈনিক পূর্বকোণের প্রতিষ্ঠাতা আলহাজ্ব মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী। ১৯৩৩ সালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম রাউজান এসেছিলেন। তাঁর আসার উদ্দেশ্য ছিল সাহিত্য সম্মেলন করা। কবি তিন রাত দুই দিন অবস্থান করেছিলেন ইউসুফ চৌধুরীর কাচারী ঘরে। তাঁর আগমনে ধন্য হয়েছিল পুরো রাউজানবাসী। তেমনি ইউসুফ চৌধুরীর কারণে ধন্য হয়েছিল হাজী বাড়ী। ছাত্র জীবন শেষ করে তিনি প্রথমে রাউজান ফকিরহাটে ‘পাঠকবন্ধু’ নামে একটি লাইব্ররী প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৪৫ সালে চট্টগ্রাম শহরে এসে জুবলী রোড ‘নিউজ ফ্রন্ট’ নামে বইয়ের ব্যবসার পাশাপাশি ঢাকা ও করাচী থেকে প্রকাশিত পত্রিকার এজেন্সী নেন। তাঁর সেই ব্যবসার পার্টনার ছিলেন তাঁর এক নিকট আত্মীয়। ইউসুফ চৌধুরীর জীবনের কয়েকটি ঘটনা আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় হতে পারে। ’৩০ এর দশকের বিএবিটি এবং আরবীতে উলা পাশ করেন তিনি। সে সময় তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘নিউজ ফ্রন্টে’ ছাত্ররা ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে বই পড়ত বলে শুনা যায়। দৈনিক পত্রিকা থেকে শুরু করে দেশী-বিদেশী ম্যাগাজিন এই লাইব্রেরীতে পাওয়া যেত। ’৫০ এর দশকের শেষ দিকে তিনি ‘সিগনেট প্রেস’ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে এটি চট্টগ্রামের ১ নম্বর প্রেস হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। আমি নিজেও প্রেস ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলাম। কদম মোবারক বাই লেইনে ’৯০ দশকের দিকে আমার একটি প্রেস ছিল ‘মিনহাজ প্রিন্টার্স’। ওই সময় চট্টগ্রাম প্রেস মালিক সমিতির সভাপতি ছিলেন দৈনিক আজাদীর সম্পাদক একুশে পদকে ভূষিত এম.এ মালেক। ’৭০ এর দশকে শেষের দিকে ‘দোলনা ডাইজেস্ট’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং পরবর্তীতে ‘প্রভাতী’ নামে একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু নানা প্রতিকুলতার কারণে সেটা প্রকাশ করতে না পারলেও ১৯৮৬ সালে তিনি আধুনিক সংবাদপত্র দৈনিক পূর্বকোণ বের করেন। এটি ছিল চট্টগ্রামের সংবাদপত্র পাঠকদের কাছে একটি নতুন অধ্যায়। তিনি ছিলেন চট্টলদরদী একজন মানুষ। চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য প্রতিষ্ঠিত বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। এই সংগ্রাম কমিটির সভা করার জন্য তিনি বৃহত্তর চট্টগ্রামে জেলা উপজেলায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। ইউসুফ চৌধুরীর মৃত্যুর পর পত্রিকাটির হাল ধরেছিলেন তাঁর সুযোগ্য সন্তান তসলিম উদ্দিন চৌধুরী। কিন্তু বর্তমানে তিনিও ইহজগৎ ত্যাগ করেছেন।
ইউসুফ চৌধুরী ছিলেন একজন গর্বিত পিতা। তাঁর সকল সন্তানদের সুশিক্ষিত ও যোগ্যরূপে তৈরি করেছিলেন। প্রকৌশলী, ব্যবসায়ী প্রকাশক, চিকিৎসক ইত্যাদি বিশেষায়িত পেশার শীর্ষে পৌঁছেন তাঁর সন্তানেরা। একজন বইপ্রেমী মানুষ হিসেবে তিনি নিজেকে পরিচিত করেছিলেন। কর্মজীবনের শুরুই করেছেন রাউজান ‘ছাত্রবন্ধু লাইব্রেরী’ প্রতিষ্ঠা করে বই বিপনের মাধ্যমে। তৎকালীন সময়ে বই প্রকাশের মত ব্যতিক্রমী কাজও হাতে নিয়েছিলেন তিনি। প্রকাশ করেছিলেন ‘আবুল ফজলের শ্রেষ্ঠ গল্প’, মুর্তুজা বশীরের ‘এন্ট্রমেরীন’ ও নজরুল বিষয়ক নাটকের বই ‘কবিদা’। আমার মরহুম পিতা আলহাজ্ব আবদুল মাবুদ সওদাগরের সাথে ইউসুফ চৌধুরীর খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। তিনি ছিলেন একজন মানবিক মানুষ। প্রকাশ্যে এবং গোপনে অনেক সামাজিক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ধর্মীয় প্রতিষ্টানে আর্থিক সহায়তার কথা জানা যায়। দেশের অনেক বরেণ্য বুদ্ধিজীবী, লেখক, রাজনীতিবিদ, সমাজপতি মরহুম ইউসুফ চৌধুরী সম্পর্কে উপস্থাপন করেছেন সমাজে তাঁর রেখে যাওয়া অবদানের জন্য।
জীবনযুদ্ধে যে ক’জন দেশবরেণ্য ব্যক্তি সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন আলহাজ্ব মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী তাদের অন্যতম। সবসময় তিনি সাধারণ মানুষের কথা ভাবতেন মানুষের সুখ দুখের সাথী হয়ে থাকার চেষ্টা করতেন। কোন অন্যায় বা অসত্যকে প্রশ্রয় দিতেন না। আধুনিক বস্তুনিষ্ট সংবাদপত্র বলতে যা বোঝায় পূর্বকোণ হলো তার দৃষ্টান্ত। আমার ধারণা যদি ভুল না হয় তাহলে বলতে হয় চট্টগ্রামের মফস্বল এলাকাগুলোতে দৈনিক পূর্বকোণের চাহিদা বেশি। শুরু থেকে এপর্যন্ত পূর্বকোণ তাদের পাঠকদের মন জয় করে আসছে। কোন বিতর্কিত বা উস্কানীমূলক খবর এপর্যন্ত ছাপিয়েছে তা কেউ বলতে পারবে না। এসব কিছুর মূলে হচ্ছেন একজন ব্যক্তি তিনি হচ্ছেন পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাতা মরহুম আলহাজ্ব মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী। তাঁকে হারিয়ে আমরা চট্টগ্রামবাসী সত্যিকারের একজন দেশপ্রেমিককে হারিয়েছি। বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য ইউসুফ চৌধুরী অনুকরণীয় হয়ে থাকবেন। ১৫তম মৃত্যুবার্ষিকীতে মরহুমের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধানিবেদন করি এবং তাঁর রুহের মাগফিরাত কামনা করি। মহান আল্লাহ’তালা যেন তাঁকে জান্নাতবাসী করেন। আমীন।
লেখক : শ্রম বিষয়ক সম্পাদক, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ